চিত্রশিল্পী ও ফ্যাশন ডিজাইনার
আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলার পর জেল থেকে যখন দেশে আসেন বঙ্গবন্ধু তারপরই নিয়মিত এই কালো কোট পরতে থাকেন, যা পরবর্তী সময়ে তার অনুসারী ও সহযোদ্ধারা পরতে শুরু করেন। এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দেশীয় ফ্যাশন আমাদের সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়। তখন এই মুজিব কোট শুধুমাত্র একটি ফ্যাশন হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতীক হিসেবেও বিস্তার লাভ করে।
ব্যক্তিকে নিয়েই ব্যক্তিত্ব। মানুষ বিভিন্ন অবস্থানে (Situation) ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় (Role) বিভিন্ন ভাবে আচরণ করে থাকে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের সব আচরণের সমষ্টিই হলো ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ব্যক্তিত্বেরই প্রকাশ।
জীবন প্রভাতেই তিনি দুর্লভের কামনায় অধীর হয়ে দুর্গম পথের যাত্রী হয়েছিলেন। বঙ্গ সংস্কৃতির অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে, সালটি ছিল ১৯৭১, ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। অর্থাত্ টুঙ্গিপাড়ার যুবক ছেলেটি যেদিন রাজনীতি শুরু করেছিলেন সে দিন থেকেই নিজের চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন, একইসাথে এগিয়েছেন চিন্তা বাস্তবায়নে। চিন্তার বাস্তব রূপ দিতে গিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেলে সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা যায় না।
বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষদের জাগ্রত করেছিলেন এবং তাদের সংগ্রাম ও আত্মবলিদানের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। নিজের দেশ, দেশের মানুষ ও সংস্কৃতিকে বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে লালন করতেন। তাই তার ব্যক্তিত্ব ও পোশাক পরিচ্ছদের মধ্যে স্বদেশীয় ছাপ লক্ষ করা যায়।
রাজনৈতিক মতাদর্শের মিল না থাকলেও বিশ্বে যেসব রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিত্ব ও তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ আজও আমাদের মনের ভেতরে গেঁথে আছে তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পোশাক অন্যতম। পায়জামা-পাঞ্জাবির সাথে কালো কোট, মোটা ফ্রেমের চশমা হাতে বাঁ ঠেঁটে পাইপ—এমন ব্যক্তিত্ব বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল। যেমন জহরলাল নেহেরুর ক্যাপ, লম্বা কোট ও বুক পকেটে গোলাপফুল, মহাত্মা গান্ধীর খাদি কাপড়ের ধূতি ও চাদর, চেগুয়েভারার মিলিটারি কোট ও ক্যাপের স্টাইল আজও 'ফ্যাশন আইকন' হিসেবে আমাদের মনের মধ্যে রয়ে গেছে।
প্রথম জীবনে বঙ্গবন্ধু কিন্তু এই কোট ব্যবহার করতেন না, শুধুই ছিল পাঞ্জাবি-পায়জামা। ব্রিটিশ খেদাও বা স্বদেশি আন্দোলনের সময় গান্ধী, জহরলাল নেহেরু, জিন্না, আবুল কালাম আজাদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাষানীর পোশাকে স্বদেশি ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশ বিভাগ, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের উদ্ভব, ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন মুসলিম লীগ বিরোধ এবং আওয়ামী লীগ গঠন, '৫২-র ভাষা আন্দোলন, অতঃপর জেল জীবন শুরু হয় এই মহান নেতার। সম্ভবত এ সময়েই তার মধ্যে এ বঙ্গের স্বাধীনতার চিন্তা এবং আন্দোলনের পরিকল্পনার স্তরগুলো উদ্ভাসিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২১ দফা, ১৯৬৪ সালে ১১ দফা, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলার পর শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ইতিহাস পাঠ করে বা ছবির অ্যালবাম দেখে অনুমান করা হয় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলার পর জেল থেকে যখন দেশে আসেন বঙ্গবন্ধু তারপরই নিয়মিত এই কালো কোট পরতে থাকেন, যা পরবর্তী সময়ে তার অনুসারী ও সহযোদ্ধারা পরতে শুরু করেন। এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দেশীয় ফ্যাশন আমাদের সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়। তখন এই মুজিব কোট শুধুমাত্র একটি ফ্যাশন হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতীক হিসেবেও বিস্তার লাভ করে।
মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলন ও বিদেশি পণ্য বর্জন থেকে যেমন দেশি সুতায় বোনা (চরকায় কাটা সুতা দিয়ে তৈরি) মোটা কাপড় খাদির আবির্ভাব ঘটল। তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশি চেতনা, দেশ মাতৃকার প্রতি ভালোবাসা থেকে এলো একটি পোশাক। সোজা কথায় দেশপ্রেম মোড়ানো মুজিব কোটের আবির্ভাব ঘটল বাংলাদেশে।
বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্রের চেতনা সঞ্চার করতে চেয়েছেন। দেশের গণমুখী সংস্কৃতিকে বিকশিত করার উদ্দেশ্যে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ফ্যাশন যা কবি, শিল্পী ও ডিজাইনারদের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পোশাক-আশাক—এটাই ছিল তার চিন্তায়।
৫০০ বছরে মোগল, পাঠান, ইংরেজ—কারও পোশাকের প্রভাব এই বাংলায় স্থায়ী হতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পোশাকে অর্থাত্ মুজিব কোটে পরবর্তী প্রজন্মও আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছে।
গায়ে খাদি জড়িয়ে গান্ধী যেমন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন দাঁড় করিয়েছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু মুজিব কোট পরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন।
হাতাবিহীন কালো কোট, হাইনেক, নিচে দুটি পকেট—এই পোশাক পরেই বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে সাক্ষাত্ করেছেন সর্বোপরি নিজেকে বাঙালির ফ্যাশন আইকন হিসেবে বিশ্বের দরবারে হাজির করেছেন।
আন্দোলন করে তিনি নিজেকে যেমন গণতান্ত্রিক নেতা রূপে গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি তিনি পোশাক-পরিচ্ছদ এনেছিলেন নতুন ধারা। নিজের দেশের মানুষের কৃষ্টি কালচার ও পোশাক-আশাক নিয়ে বঙ্গবন্ধু আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এরই প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর হোটেল পূর্বাণীতে দেওয়া তার এক বক্তৃতায়, 'বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না বলেই বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি। যে সংস্কৃতির সাথে দেশের মাটি ও মনের সম্পর্ক নেই তা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।' বঙ্গবন্ধু উপমহাদেশের একমাত্র নেতা যিনি নিজের দেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে কৃষ্টি ও কালচারকে এমন দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছিলেন। তার মতো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের এমন রাজনৈতিক নেতা বিশ্বে দুর্লভ।