অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ
খন্দকার মোশতাকের অবৈধ ক্ষমতা দখলকে আইনানুগ করার জন্য ১৬ অক্টোবর বঙ্গভবনে জাতীয় সংসদ সদস্যদের এক বৈঠক ডাকা হয়। এই বৈঠকে সংসদ সদস্যগণ যাতে উপস্থিত না হন তার জন্য ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। সিরাজগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এম পি সৈয়দ হায়দার আলী সাহেবের বাড়িতে আমি, মোস্তাফিজুর রহমান পটল (৭ই নভেম্বর নিহত), মোজাফফর হোসেন, হাসান আলী তালুকদার, করিম বেপারী প্রমুখ বৈঠক করি এবং সিদ্ধান্ত নেই যে আসন্ন বৈঠকে এমপিরা যাতে উপস্থিত না হয় তার চেষ্টা করতে হবে। এমপি ছাড়াও আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সেদিন কাজ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা বিভাগের বজলুর রহমান ও টাঙ্গাইলের ফজলুল হক, সাহারা খাতুন, রওশন আরা মোস্তাজির প্রমুখ। এছাড়াও ছাত্র যুবনেতারাও মোশতাকের সভায় না যাওয়ার জন্য ক্যাম্পেইন করেন।
ব্যাপক তত্পরতা চালানোর উদ্দেশ্যে বেগম সাজেদা চৌধুরী, শামসুদ্দিন মোল্লা, সিরাজুল হক, লুত্ফর রহমান, আনোয়ার চৌধুরী, মফিজুল ইসলাম খান কামাল, ডঃ এসএ মালেক, কামরুজ্জামান মাষ্টার, ডাঃ আবুল খায়ের, নুরুল আলম, রওশন আলী, এখলাস উদ্দিন আহমদ, কসিমুদ্দিন আহমদ, তফিজউদ্দিন আহমদ, দবির উদ্দিন, রাশেদ মোশারফ, সাইফুল ইসলাম, ডাঃ মেসবাহ উদ্দিন, আবদুল রশিদ (মাগুরা), সালাউদ্দিন ইউসুফ, ময়েজ উদ্দিন, সরদার আমজাদ হোসেন প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাত্ করি এবং তারাও উত্সাহের সঙ্গে বঙ্গভবনে না যাবার পক্ষে মত দেন এবং সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকেন।
১৬ অক্টোবর সকাল ৯টায় তেজগাঁওস্থ এমপি হোস্টেলের নিচের তলায় প্রায় একশ' এমপি উপস্থিত হন। আমরা দল বেঁধে না যাওয়ার পক্ষে প্রকাশ্যে লবি শুরু করি। শুরু হয় উত্তেজনা। জেলখানা হতে সংবাদ এসেছিল খন্দকার মোশতাকের মিটিং যেন সফল না হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সোহরাব হোসেন, এবং রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া প্রমুখ শেষ পর্যন্ত এই ফর্মূলায় আসেন যে, তারা কয়েকজন গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাবেন। কিন্তু তারা ছিলেন দোদুল্যমান। আমরা ঠিক করে দিলাম সিরাজুল হক এমপি সংসদের পক্ষে কথা বললেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সেদিন সভাটি শেষ হয়। কয়েকজন বঙ্গভবনে চলে যান।
জনাব সিরাজুল হক সাহেব কথা রেখেছিলেন। তিনি খন্দকার মোশতাককে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'আমি আপনাকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে সম্বোধন করতে পারি না। কোন্ সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে আপনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন এবং বঙ্গভবনে আশ্রয় নিয়েছেন আর আমাদের বলছেন রাষ্ট্রপতি হিসাবে মেনে নিতে? তাহলে প্রথমে আপনাকে বলতে হবে কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে? আপনাকে আমরা বৈধ রাষ্ট্রপতি বলতে পারি না, মেনে নিতে পারি না।' তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সাংবিধানিকভাবে, আইনগতভাবে অবৈধ রাষ্ট্রপতি খুনি মোশতাক প্রচণ্ড ধাক্কা খান। খুনিরা উপলব্ধি করে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। বৈধতা না পাওয়ার ফলে ক্যান্টনমেন্টে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়। পরের ঘটনাসমূহ ইতিহাসের ভিন্ন অধ্যায়। ভিন্ন কথা।
লেখক:৭২ সংবিধানের খসড়া প্রণেতা, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী