আজ জাতীয় শোকদিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম আঘাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাতের কারণে জাতির সবস্বপ্ন, সবসংকল্প অনিশ্চয়তার অন্ধকারগলিতে থমকে দাঁড়ায়। আমাদের জাতিসত্ত্বার স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার ও নির্মানের স্থপতি, সুনিপুণকারিগর—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিপীড়িত জাতিকে অধঃপতনের কিনারা থেকে টেনে তুলেছিলেন। দু'শত ছেষট্টি দিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও ত্রিশলক্ষ বনীআদমের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ—পাকিস্তানীদের শোষণে হয়ে উঠেছিল শ্মশানতুল্য শূন্যতার হাহাকারে নিঃস্তব্ধ। তাই স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পূণঃগঠনে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন আরেক সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। তিনি জাতির মৌলিকভিত্তি রচনায় রেখে গেছেন অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর, যা তাঁকে নিয়েগেছে শতফুলের চমত্কৃত আকর্ষণের বিশাল উচ্চতায়। ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ, ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, স্বতন্ত্র মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠাসহ ইসলাম ও মুসলমানের খেদমতে বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। এ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ দেশের উন্নয়ণের জন্য খুব সামান্য সময়ই পেয়েছিলেন। কারণ, ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণ্যচক্রান্তে তিনি অন্যায় হত্যাকান্ডের শিকার হন অথচ অন্যায় হত্যাকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে আইন বহিঃর্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপকর্ম ও মহাপাপ। মহান আল্লাহ্ বলেন "কোনো নরহত্যা কিংবা পৃথিবী বা সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণে বিচারের রায় ছাড়া যদি কেউ কোনো মানুষকে হত্যা করে, তা হলে সে যেন সমস্ত মানুষকে(মানবতাকে) হত্যা করেছে"(মায়েদা:৩২)। মহান আল্লাহ্ আরো বলেন "যে লোক কোনো মু'মিন ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করবে, তার প্রতিফল হচ্ছে জাহান্নাম। সে চিরদিন সেখানেই থাকবে"(নিসা:৯৩)। পবিত্র কুরআনে আরো আছে "আল্লাহ্ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না। আর যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয় আমি তার উত্তরাধীকারীকে অবশ্যই এর প্রতিকারের অধিকার দিয়েছি..."(বানী ইসরাইল:৩৩)। অন্যায় হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে পবিত্র কুরআনে 'কিসাস'(ইসলামি দন্ডবিধি যাতে বান্দার 'হক' অগ্রাধিকার পায়, অপরাধীর অপরাধের অনুরূপ শাস্তির বিধান হয় যেমন 'খুনের বদল খুন' ইত্যাদি) ঘোষণা করে মহান আল্লাহ্ বলেন "হে বিশ্বাসীগণ। তোমাদের জন্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য 'কিসাস' ফরজ করে দেওয়া হয়েছে...'কিসাসে'র মধ্যেই তোমাদের জন্য জীবন নিহিত রয়েছে" (বাকারা: ১৭৮,১৭৯)। প্রিয়নবী (স.) অন্যায় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন "কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া 'ফিসক' বা মহাপাপ এবং হত্যা করা কুফরি"(বুখারি)। প্রিয়নবী (স.) আরো বলেন "যে লোক আমাদের ওপর অস্ত্র নিক্ষেপ করবে সে আমাদের দলের মধ্যে গণ্য হবে না"। হত্যার ন্যায় জঘন্যতম অপকর্ম ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। এতে সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। মহান আল্লাহ্ আরো বলেন "বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও মারাত্মক"(বাকারা:১৯১)। মহান আল্লাহর আদেশ ও প্রিয়নবীর (স.) আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন হলো সামাজিকশান্তি, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা। কেননা, মানুষের জীবন-সম্পদ সবই তো একেকটি পবিত্র আমানত। প্রিয়নবী (স.) বিদায় হজ্বে বলেন "হে মানবজাতি। তোমাদের এই মাস, এই শহর, এই দিন যেমন পবিত্র নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের দিন কেয়ামত পর্যন্ত তোমাদের জীবন-সম্পদ, সম্মান, সম্ভ্রম তোমাদের পরস্পরের কাছে তেমনি পবিত্র"(বুখারি)। অন্যায় হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে শাসকগোষ্টীর দায়িত্ব হলো সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করা। সুশীলসমাজ তথা জ্ঞানী-গুণি বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য হলো বাচনিক প্রক্রিয়ায় সত্যের পক্ষ অবলম্বন ও সত্য উদঘাটনে সোচ্চার হওয়া এবং সাধারণ মানুষের উচিত হত্যাসহ সব অন্যায় কর্মকাণ্ডকে অন্তর থেকে তীব্রঘৃণা করা। এটাই ইসলামের বিঘোষিত অপরাধ দমন কৌশল। প্রিয়নবী (স.) বলেন "তোমাদের মধ্যে কেউ সমাজবিরোধী অন্যায় ও গর্হিত কাজ হতে দেখলে সে যেন তা শক্তি প্রয়োগে প্রতিহত করে। শক্তি প্রয়োগে সক্ষম না হলে যেন সদুপদেশ দ্বারা প্রতিবিধান করে এবং তাতেও সক্ষম না হলে যেন তা আন্তরিকভাবে ঘৃণা করে। আর এটাই হলো দূর্বলতম ঈমানের প্রকাশ"(বুখারি-মুসলিম)।