পটকা মাছ খেয়ে মানুষের মৃত্যুর খবর ইদানীং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। অতি সমপ্রতি পটকা মাছ খেয়ে ঢাকা শহরের ধোলাইপাড়ে একই পরিবারের ৪ জন সদস্যের মৃত্যুর খবর দেশবাসীর মাঝে আতংকের সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের খবর প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। অথচ পটকা মাছ জাপানে একটি দামি ও সুস্বাদু মাছ হিসাবে পরিচিত। জাপানীদের নিকট পটকা মাছ তাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ। সাধারণত বড় বড় পার্টিতে স্লাইস (slice) করে কাঁচা (raw) পটকা মাছ উপস্থাপন করা হয়। জাপানী ভাষায় এটাকে "ছাসিমি" বলে। কোনো কোনো জাপানী পটকা মাছকে কাজের উদ্যম সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে মনে করে। তবুও পটকা মাছ খেয়ে জাপানীরা মারা যায়-যদিও এর সংখ্যা পূর্বের তুলনায় এখন খুবই কম। জাপান ছাড়াও কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, চীন, মেক্সিকো ইত্যাদি দেশে পটকা মাছ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে সাধারণত ২ ধরনের পটকা মাছ পাওয়া যায়, যেমন: স্বাদুপানির পটকা ও লোনাপানির পটকা। স্বাদুপানির পটকা নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা ইত্যাদিতে পাওয়া যায় এবং লোনাপানির পটকা সমুদ্রে পাওয়া যায়। স্বাদুপানির পটকা আকারে লোনাপানির পটকার চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট। আমাদের দেশে স্বাদুপানিতে এপর্যন্ত ২ প্রজাতির পটকা (Tetrodon cutcutia এবং Chelenodon patoca) পাওয়া গেছে; উভয় প্রজাতির পটকাই কম-বেশি বিষাক্ত। কিন্তু আমাদের সামুদ্রিক পটকার প্রজাতির সংখ্যা জানা নেই। তবে সমুদ্রেও বিষাক্ত পটকার সংখ্যা অনেক।
প্রজনন মৌসুমে (বর্ষাকাল) পটকা মাছ অধিক বিষ বহন করে। তবে, পটকা মাছের বিষাক্ততা স্থান, প্রজাতি এবং ঋতুভেদে ভিন্নতর হয়। অর্থাত্, উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে পটকা মাছের যে প্রজাতিটি মারাত্মক বিষাক্ত জাপানে সেটা ততটা বিষাক্ত নাও হতে পারে। অনুরূপভাবে, বৈশাখ মাসে যে পটকা মাছটি বিষাক্ত, কার্তিক মাসে তাতে ততটা বিষ নাও থাকতে পারে। তাই অপেক্ষাকৃত কম বিষ ধারণকৃত সময়ে পটকা মাছ খেয়ে কারো কোনোরূপ দুর্ঘটনা না ঘটে থাকলে অজ্ঞতাবশত অধিক বিষ ধারণকৃত সময়ে পটকা খেয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী সামুদ্রিক পটকার ক্ষেত্রে (TTX বহনকারী) মানুষের জন্য বিষের মাত্রা হচ্ছে প্রতি গ্রামে দশ মাউস ইউনিট (MU, বিষের একক) অর্থাত্, পটকার প্রতি ১ গ্রাম অংশে যদি ১০ MU বিষ থাকে তবে তা মানুষের জন্য বিষাক্ত। এ পরিমাণ বিষ খেলে তার মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হবে এবং এভাবে যদি এক সাথে ১০ হাজার MU বিষ একজন সুস্থ-সবল মানুষ খেয়ে ফেলে তবে নির্ঘাত মৃত্যু। একইভাবে স্বাদুপানির পটকার ক্ষেত্রে প্রতি গ্রামে ৩ MU বিষ থাকলে তা বিষাক্ত এবং ৩ হাজার MU একসাথে খেলে মৃত্যু অবধারিত। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে সামুদ্রিক পটকার চেয়ে স্বাদুপানির পটকা অধিকতর বিষাক্ত; কেননা স্বাদুপানির পটকা খেলে অপেক্ষাকৃত কম বিষেই মানুষ মারা যাওয়ার আশংকা থাকে। তাই সামুদ্রিক এবং স্বাদুপানির পটকা চেনার ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। তাছাড়া, সামুদ্রিক পটকার মধ্যে কোনটি বিষাক্ত এবং কোনটি বিষাক্ত নয় এবং কোনটি কোন সময়ে বিষাক্ত এধরনের যথেষ্ট তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি স্থানভেদে বিষাক্ততার তারতম্য কতটুকু তাও আমরা জানি না। তাই পটকা মাছ খাওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকাই উত্তম।
পটকা মাছের বিষ সায়ানাইড(Cyanide) এর চেয়েও অধিকতর বিষাক্ত এবং জীবননাশক। গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোনো কোনো সামুদ্রিক পটকা প্রতি গ্রামে ৪০০০ MU পর্যন্ত বিষ (TTX) বহন করে থাকে অর্থাত্ একজন সুস্থ-সবল ব্যক্তি এরূপ বিষাক্ত পটকার ৩ গ্রাম খেলেই বিষাক্রান্ত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে। অনেকের ধারণা, পটকা মাছ রান্না করলে এর বিষাক্ততা নষ্ট হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অত্যধিক তাপে বিষের উপাদান (Chemical Structure) এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর হতে পারে-কিন্তু এতে বিষাক্ততার খুব একটা তারতম্য হয় না।
রোগীর দেহে পটকা মাছের বিষক্রিয়ার মাত্রা গৃহীত বিষের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। স্বাদুপানি এবং মিঠাপানির পটকার বিষাক্ততার লক্ষণ রোগীর দেহে প্রায় একইরকম। পটকা মাছের বিষকে Neurotoxin কিংবা Sodium channel blocker বলা হয়। পটকা মাছের বিষ মানবদেহের নার্ভ সেলের Voltage-gated sodium ion channel এর সাথে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। ফলে সোডিয়াম প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এতে মানবদেহে ইলেকট্রোলইটিক্যাল ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়।
পটকা মাছের বিষাক্ততায় ১ ঘণ্টার মধ্যে পর্যায়ক্রমে রোগীর ঠোঁট ও জিহবায় জড়তা, মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, মুখে শুষ্কতা, মাংসপেশীতে ব্যথা ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। পর্যায়ক্রমে রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে থাকে। পরিণামে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে শ্বাসকষ্টে মৃত্যুও হতে পারে। তাই রোগীর প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোগীকে স্থানীয় হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে এবং চিকিত্সা গ্রহণ করতে হবে।
পটকা মাছের বিষ (টেট্রোডোটক্সিন) শুধুমাত্র পটকা মাছেই নয় অন্যান্য জীবেও পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে—অকটোপাস, স্টার ফিশ, শামুক, আফ্রিকান ব্যাঙ, ঝিনুক, নিউট, ফ্লাটওয়ার্ম, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রজাতিতে টেট্রোডোটক্সিন এর এরূপ উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের নিকট এখনও রহস্যময়।
লেখক :বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন বিজ্ঞানী