'এই স্কুলে এখন আমি না পড়লেও এটা আমার স্কুল' আমাদের পাঠশালা। এখানে আমি পাঁচ বছর পড়েছি, এই স্কুলটাই আমার...' এভাবেই বিদ্যালয়টির প্রতি ভাল লাগা আর ভালোবাসার কথা জানায় প্রাক্তন ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। মিরপুর পল্লবীর ডি-ব্লকে অবস্থিত 'আমাদের পাঠশালা'। এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই এই পাঠশালার শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র, ডাক্তার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার কিছু উদ্যোগী তরুণ ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু করে 'আমাদের পাঠশালার কার্যক্রম। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আপাতত বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু রয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণীর 'প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা' আর অষ্টম শ্রেণীর 'জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় শতভাগ পাসসহ সৃজনশীল ও মানবিক শিক্ষায় অধিক গুরুত্ব দিয়ে পাঠদান করা হয় স্কুলটিতে। অষ্টম শ্রেণীর পর অনেক শিক্ষার্থী পার্শ্ববর্তী স্কুল 'ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উচ্চ বিদ্যাপীঠ'-এ ভর্তি হলেও ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা ভীড় জমায় 'আমাদের পাঠশালা'র ছোট্ট আঙ্গিনার আম ও নীম গাছতলায়। সেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী মিলে চলে প্রাণবন্ত শিক্ষণীয় আড্ডা। বঞ্চিত শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা ও মানবিক বিকাশ আমাদের পাঠশালার যাত্রা শুরু বলে জানান প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আবুল হাসান রুবেল। তিনি বলেন, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিষয়ে সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গী বদলিয়ে দেয়া পাঠশালার লক্ষ্য। স্কুলে প্রতি শনিবার শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে চলে-গান, ছবি আঁকা, খেলাবিষয়ক ক্লাস।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউবা ঠোঙা বানিয়ে, কেউবা পেপার বিলি করে পরিবারকে সাহার্য্য করে তবেই পড়তে আসে পাঠশালায়। তাদের উপার্জনে কিছু টেকনিক্যাল কাজ, সেলাই ট্রেনিং, হাতের কাজ, ছবি আঁকা এসব দিয়ে দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দেয় স্কুলটি। কারণ কোনভাবেই পড়তে আসা শিশুরা যেন শিক্ষা থেকে ঝরে না যায়। মাঝে কিছুদিন টিফিনেরও ব্যবস্থা চালু থাকলেও বর্তমানে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় আর্থিক অভাবে এখন আর টিফিন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রুবেল বলেন, 'আমাদের পাঠশালা বর্তমানে ট্রাস্ট হিসেবে রেজিট্রেশন পাওয়া। তবে একটি বিল্ডিং করতে পারলে কলেজ পর্যন্ত চালু করার ইচ্ছে রয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিকের ব্যবস্থা করতে পারলে আরো ভালো হতো। তিনি বলেন, সরকারি পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে আনতে আমরা অন্যান্য বইও স্কুলের পাঠ্যসূচিতে রেখেছি। আমাদের পাঠশালার শিক্ষার্থীরা অন্য স্কুল-কলেজে এখানকার মতো পরিবেশ পায় না বলে বিষণ্নতায় ভোগে। নবম শ্রেণীতে বড়ুয়া শিক্ষার্থী হেলাল ফরাজী বলে, অন্য স্কুলে আমাদের 'বস্তির ছেলে' বলে গালি দেয়। একবারের বেশি কোনকিছু বুঝিয়ে চাইলেই বকা শুনতে হয়।
পাঠশালার শিক্ষার্থীদের মানবিকতা অনুকরণীয় উল্লেখ করে সহকারী প্রধান শিক্ষক রনজিত্ মজুমদার বলেন, স্কুলে পরীক্ষা চলছিল, পথে আমাদের এতজন ছাত্র দেখে, কোলের সন্তান হারিয়ে একজন মা অঝোরে কাঁদছেন। আমাদের শিক্ষার্থী ছেলেটি ঐ মায়ের সন্তান খুঁজে পাইয়ে দিয়ে, তবেই পরীক্ষার হলে এসে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, পঞ্চম শ্রেণীতে সব শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করলেও একটি ছাত্র ১২ ঘন্টা কাজ করার কারণে সে পাস করতে পারে না। এই একজন সহপাঠীর জন্য সে বছর পিএসসির ভালো ফলাফলের কোন আনন্দ শিক্ষার্থীরা করেনি।
চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র রাব্বী। বয়স আট। তার ক্লাসের সবাই বিজ্ঞানী বলে। রাব্বির নিজেরও ইচ্ছে বড় হয়ে সে বিজ্ঞানী হবে। নিজে নিজে ফ্যান, ব্যাটারি চালিত সাইকেল, টেপরেকর্ডার এসব নিজ হাতেই তৈরি করতে পারে। স্কুলের একজন শিক্ষক চিকিত্সক। তিনি শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন। এই ক্লাসের ছাত্র হিসাব স্যারের মতো চিকিত্সক হতে চায়।
স্কুল থেকে বিদায় বেলায় 'আমাদের পাঠশালা'র প্রাক্তন ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস ও খাদিজাতুল আক্তার রুমী এই প্রতিবেদককে 'সকাতরে ওই কাদিছে সকলি, শোন শোন পিতা/কহ কানে কানে, শোনাও প্রাণে প্রাণে, মঙ্গলও বারতা.....' রবীন্দ সঙ্গীতটি শোনান।