মো. জাভেদ-বিন-এ-হাকিম

কনিতা, রবিতা ও বাসিতাহ্—সহোদর তিন বোন। বাবার মতো তারাও ভ্রমণপিপাসু। মাঝেমধ্যেই শর্ট কিংবা লং ট্যুরে যাওয়া চাই। বিশেষ করে রবিতা কয়েকদিন যেতে না যেতেই ভ্রমণে যাওয়ার বায়না ধরে। আমিও তিন কন্যা বলতে অজ্ঞান। তাছাড়া এমনিতেই আমি শিশুদের একটু বেশি ভালোবাসি। তাই ওদের আবদার আমি উপেক্ষা করতে পারি না। বর্তমান নগর জীবনে ঢাকার আকাশ উঁচু উঁচু দালানে ঢেকে গেছে। চারপাশে ইট, কাঠ আর কংক্রিটের আস্তর, সবুজের দেখা মেলা ভার। বুকভরা নিঃশ্বাস, শিশু সুলভ দৌড়ঝাঁপ সে তো আজ কল্পনার রাজ্য। দু-চারটি পার্ক, উদ্যান যাও আছে তাও আবার বিকৃত মানুষের পদভারে পূর্ণ। এর মাঝে ভরসা বারান্দার গ্রিল, সেখানেও আবার বখাটেদের উত্পাত। তাই শিশুদের মানসিক বিকাশের স্বার্থে শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে ছুটে যেতে হয় দূরে কখনো বহুদূরে। যেখানে কোমল প্রকৃতি তার আপন গৌরবে উজ্জ্বল। এবার ওদের বায়না ছিল ক্যাপ্টেন কক্সের নামে বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার। এবারের ট্যুরে শিশু থাকায় তাই দুই দিনের বদলে চার দিনের সময়সূচি তৈরি করা হয়েছিল। দীর্ঘ ষোল ঘণ্টার বাস জার্নি শেষে দুপুর বারটা চল্লিশ মিনিটে গিয়ে পৌঁছলাম কক্সবাজারের কলাতলী ডলফিন মোড়ে। বাস থেকে নেমে সোজা হোটেলে। বিচে যাওয়ার জন্য শিশুদের যেন তর্ সইছিল না। দুপুরের লাঞ্চ শেষে একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শিশুদের উচ্ছ্বাসের কারণে তা আর হলো না। বের হয়ে গেলাম দরিয়া নগরের পানে। স্বল্প দূরত্বের দরিয়া নগর পর্যটন কেন্দ্রে পৌঁছে জনপ্রতি বিশ টাকার টিকেট কিনে প্রবেশ করলাম। গাইড হলো কিশোরী মেয়ে বিউটি, লাইফ পার্টনার কুলসুম যারা আমার মেয়েদেরকে অত্যন্ত দক্ষতার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। বাচ্চারাও বেশ মজা পেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে এবার সোজা লাবনী বিচ পয়েন্টে এলাম। ছলাত্, ছলাত্ ঢেউয়ের সাথে ওরা তিন বোনও লাফিয়ে উঠল। আমার তিন কন্যা যেন ঠিক এই মুহূর্তের জন্যই অধীর আগ্রহে ছিল। পরেরদিন সকালে সমুদ্রস্নান। কলাতলী বেলাভূমি তুলনামূলক নিরিবিলি, তাপমাত্রা সহ্যের মধ্যে। কনিতার বায়না, 'আব্বু তুমিও আমাদের সাথে সমুদ্রে নামবে।' ওদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে নেমে পড়লাম নোনা জলে। সবার ছোটটি বাসিতাহর সে কি আনন্দ! বাসিতাহর খিলখিল হাসি ভ্রমণের সার্থকতা বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘ সময় হৈ-হুল্লোড় করে ফিরলাম হোটেল লবিতে। আশ্চর্য বিষয়, যাদের জন্য চার দিনের সময় নিয়ে এলাম, তাদের মধ্যে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। লাঞ্চের পর কানা রাজার গুহা আর ইনানী ঘুরব। সবাই ঝটপট রেডি, হাস্যোজ্জ্বল ড্রাইভার রতনের মাইক্রোও রেডি। প্রথমেই পাটুয়ার টেকে কানা রাজার গুহার দিকে ছুটছি। আমারও প্রথম দেখা হবে। হিমছড়িতে খানিকটা সময় ব্রেক, কুলসুমের বায়না খোসা জড়ানো তেঁতুল আর পাহাড়ি বরই নিতে হবে। তেঁতুলের স্বাদ নিতে নিতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পাটুয়ার টেক এসে পৌঁছলাম। যতটা উচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছি তারচেয়ে বেশি বিমর্ষ হয়েছি প্রকৃতির দান কানা রাজার গুহা দেখে। রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে গুহার মুখ পাহাড় ধসে আটকে গেছে। আফসোস প্রকৃতির কৃপাকে সদ্ব্যবহার করতে জানি না আমরা। পাটুয়ার টেকের সারিবদ্ধ সুপারি গাছগুলো মনে অন্যরকম দোলা দেয়। গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা ইনানী বিচে। ততক্ষণে জোয়ার শুরু। যেখানেই পাথর জেগে আছে সেখানেই পর্যটকদের ফটোসেশন। ইতোমধ্যে উচ্ছ্বাসের বাঁধ ভেঙে রবিতার নীল জলে ডুব, সঙ্গে কনিতা ও বাসিতাহর সমুদ্র শৈবালের সাথে লুটোপুটি।
ভ্রমণে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ করে, মানসিক উত্কর্ষের পাশাপাশি শিশুকে দায়িত্বশীল হতে শেখায়। চার দেয়ালের বন্দিত্ব শিশুদের মনকে সংকীর্ণ করে তোলে। অবারিত সবুজ খোলা প্রান্তর শিশুকে প্রাণবন্ত করে তোলে। যত্রতত্র নগরায়ণের হারিয়ে যাচ্ছে আজ সবুজ, নদী, খাল, হাওর, বাওড়। যতটুকু টিকে আছে তাও আবার বিষাক্ত। ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য যেন কারো কিছু করার নেই। সচেতনতার বড় অভাব। সবাই ছুটছি তো ছুটছি স্বীয় স্বার্থে। চারপাশে তাকানোর সুযোগ নেই। এমনকি কোমলমতি শিশুদের পাঠশালাও আজ বাণিজ্যিক। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। যতটুকু সময় আছে তাতেই অনেক কিছু করা সম্ভব। প্রয়োজন একটু সুস্থ মানসিকতার। আসুন আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে সচেতন হই। গড়ে তুলি আগামীর প্রাকৃতিক প্রাচুর্যময় সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। সীসামুক্ত বাতাসে বুক ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে যেন আমাদের শিশুরা বলতে পারে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'। অনেক মা-বাবাই আছেন তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত্ সুখের আশায় শুধু অর্থের পিছু ছুটছেন। অথচ সন্তান একাকিত্বে ভুগছে। অভিভাবকদের যথেষ্ট পরিমান সঙ্গ, আদর, সোহাগের অভাবে তাদের মেজাজ-মর্জি বিগড়ে যাচ্ছে। বিষণ্নতা এক সময় তাদের অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। তারা ডুবে থাকে ভার্চুয়াল জগতে, হয়ে উঠে আত্মকেন্দ্রিক। আসুন আমরা মাঝেমধ্যেই বাড়ির ছোট্ট সোনামণিদের নিয়ে ছুটে যাই দূরে বহুদূরে। যেখানে নয়ন জুড়ানো প্রকৃতি তাদের আপন করে নেবে, সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হতে অনুপ্রাণিত করবে।