
যথাযথ তত্ত্বাবধান ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ হয়ে উঠতে পারে। বর্ষায় বিস্তৃত জলরাশি আর অজস্র পাখ-পাখালীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার পাশাপাশি নৌকা ভ্রমণের আনন্দ পেতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণপিয়াসু মানুষের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠে চলনবিল। উত্তর জনপদের ঐতিহ্য চলনবিলকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। নাটোরের হালতি বিল এখন ভ্রমণপিয়াসী মানুষের কাছে মনোরম একটি দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন দেশের বিভিন্নস্থান থেকে নানা বয়সের মানুষ ছুটে আসছে এখানে। বিশাল হালতি বিলের এক ধরণের সাধারণ সৌন্দর্য্য আছে। ভরা বর্ষায় আদিগন্ত জলরাশির মাঝে দুইএকটি গ্রাম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। পানির ওপর সবুজের ছায়া। তবে বর্ষায় এর ভয়ংকর রূপ দেখে এই অঞ্চলের মানুষ আতঙ্কিত হয়। সমীহ করে। সাবধানে নৌযানে বিল পাড়ি দেয়। এরপরও প্রতি বছর প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে নৌকাডুবিতে প্রাণহানি ঘটে। তবে এবার বর্ষায় বেশি বৃষ্টি হয়নি। উত্তর থেকে পাহাড়ি ঢলও নেমে আসে নি। ফলে বিলে এখন পানি কম। হালতি বিলের সৌন্দর্য্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এর মধ্যে নির্মিত একটি পাকা রাস্তা। রাস্তাটি পানির ওপর ভেসে আছে। অবশ্য ভরা বর্ষায় তলিয়ে যায়। এখন রাস্তাটি জেগে উঠেছে। সহস্র মানুষের পদচারণা, কোলাহল। গরমে ক্লান্ত মানুষ অপরাহ্নে ছুটে আসে হালতি বিলের রাস্তায়। নাতিশীতোঞ্চ বাতাসে জুড়িয়ে
পানির ওপর হাঁটছে মানুষ। নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। পাওয়া যায় সমুদ্র সৈকতের আমেজ। নাটোর সদর উপজেলার পাটুল হাট থেকে খাজুরা পর্যন্ত রাস্তাটির দৈর্ঘ্য সাত কিলোমিটার। ২০০৪ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর রাস্তাটি নির্মাণ করে। খরচ হয় নয় কোটি টাকা। নাটোর শহর থেকে পাটুল হাটের দূরত্ব আট কিলোমিটার। অটোরিক্সায় ভাড়া ৩০ টাকা। বিলের মধ্যে নৌকায় সঙ্গীদের নিয়ে বেড়ানো যায়। ভাড়া ঘন্টায় এক শ' টাকা। ঢেউয়ের ওপর ভাসতে ভাসতে বিল দর্শন। অতি কম খরচে আনন্দ ভ্রমণের এমন সুযোগ মেলে না সহজে।
বিভিন্ন উত্স্য হতে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জানা যায়, নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জসহ মোট ৮টি উপজেলার প্রায় ৮০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ৬২টি ইউনিয়ন এবং ৮টি পৌরসভা নিয়ে চলনবিলের অবস্থান। আর এই ৮টি উপজেলার গ্রামসংখ্যা ১৬'শ টি এবং যার লোকসংখ্যা ২০ লাখের বেশি। গঠনকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১০০৮ বর্গকিলোমিটার। ধীরে ধীরে বিল ছোট হয়ে এলেও এখনও বর্ষা মৌসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩'শ ৬৮ বর্গকিলোমিটার। আর এ বিশাল বিলের বুক চিরে নির্মিত হয়েছে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক। এ মহাসড়কের দুপাশে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বিশাল জলরাশি ভ্রমণপিয়াসু মানুষদের আকৃষ্ট করে। তাই এ মহাসড়কের ৮ ও ৯ নম্বর ব্রিজের মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে এ জায়গাটি ভ্রমণপিয়াসুদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুরে অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা মরহুম অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদের হাতে গড়া চলনবিল জাদুঘর এ অঞ্চলের একটি দর্শনীয় স্থান। প্রায় ৩৫০ বছর আগে সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা ঘাসী-ই-দেওয়ানের তিশিখালীর মাজারে প্রতি শুক্রবার হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে। তাড়াশের বিনসাড়া গ্রামের কিংবদন্তীর নায়িকা বেহুলা সুন্দরীর বাবার বাড়ি, আনোয়ারা উপন্যাসের লেখক নজিবর রহমানের মাজার, রায় বাহাদুরের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমামবাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদার বাড়ি, একই উপজেলার নওগাঁ শাহ জিন্দানী মাজার , পাবনার চাটমোহরের শাহী মসজিদ, সমাজ গ্রামের শাহী মসজিদ, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির, রায়গঞ্জের মত্স্য খামার, লেখক প্রমথ চৌধুরী ও লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বুকে ধারণ করে আছে চলনবিল। বর্ষাকালে সমুদ্রের ন্যায় বিশাল জলরাশি আর শুকনো মৌসুমে সবুজের বিস্তৃত লীলাভূমি চলনবিলের বুক জুড়ে হাজার হাজার অতিথি পাখির ছুটে বেড়ানো দেখে মুগ্ধ হবে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বর্ষাকালে চলনবিলে হাজার হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। চলনবিলের বিভিন্ন উপজেলা রেস্ট হাউজগুলোর আধুনিকায়নসহ পর্যটন মোটেল গড়া তোলার উদ্যোগ নিলে চলনবিল দেশের একটি অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারে। গত সরকারের সময় বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক হায়দার আলী ও বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও তত্কালীন সংসদ সদস্য কাজী গোলাম মোর্শেদ তিশিখালী মাজার ঘিরে চলনবিলে একটি নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সে সিদ্ধান্ত আর আলোর মুখ দেখে নি।