নাটোর কাছারি মাঠ সংলগ্ন সাবেক মুনসেফ কোর্ট বা আদালত ভবনের পাশে মহারাজা রেওজগদিন্দ্র নাথ হাইস্কুল ছিল। স্থান সংকুলান সমস্যা, কর্তৃপক্ষের চাপ ও স্থানীয় কিছু বিরোধিতার কারণে মহারাজা ১৯১০ সালে বিদ্যালয়টি তাঁর নিজ বাড়ির নিকটবর্তী বর্তমান স্থানে সরিয়ে নেন।
তত্কালে নাটোরের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে 'আঞ্জুমান ইসলামিয়া' বা 'আঞ্জুমানে তাইদে ইসলামিয়া' নামে ধর্ম সভা ছিল (আঞ্জুমান অর্থ সভা বা সমিতি)। ঐ ধর্মসভার সভাপতি ছিলেন নাটোরের চৌধুরী পরিবারের খান বাহাদুর এরশাদ আলী খান চৌধুরী। তিনি নাটোর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় আঠার শ' নব্বই এর দশকে নারদ নদের পাশে মীরপাড়ায় মাদ্রাসা-ই-আঞ্জুমানিয়া নামে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়। ১৮৯৯ সালে নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে সৈয়দ আমির আলী মুসলিম শিক্ষার উন্নয়নের জন্য মাদ্রাসাগুলিতে ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তনের প্রস্তাব দেন। এরই ধারাবাহিকতা ও মহারাজা জে.এন হাইস্কুল কাছারি মাঠ সংলগ্ন স্থান হতে প্রায় এক মাইল উত্তরে রাজবাড়ির নিকট স্থানান্তরিত হওয়ায় নাটোরের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টির প্রেক্ষিতে খান বাহাদুর এরশাদ আলী খান চৌধুরীসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উদ্যোগে মীরপাড়ার মাদ্রাসা-ই-আঞ্জুমানিয়া বিলুপ্ত করে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে আঞ্জুমানিয়া এম.ই.স্কুল (মিডল ইংলিশ স্কুল) নামে একটি বিদ্যালয় চালু করা হয়। ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন পুলিন চন্দ্র গোস্বামী। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি এম.ই.স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পাকা দেওয়ালের টিনের চালা ঘরের ৮টি ক্ষুদ্র আয়তনের কক্ষে এম.ই.স্কুল পরিচালিত হতো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে পাকিস্তানের গভর্ণর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামানুসারে এম.ই.স্কুলের নামকরণ হয় প্রথমে জিন্নাহ্ মেমোরিয়াল ইংলিশ হাইস্কুল এবং পরে জিন্নাহ্ মডেল হাইস্কুল। ঐ হাইস্কুলের পর্যায়ক্রমিক প্রধান শিক্ষক ছিলেন সুরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, সুশীল চন্দ্র চক্রবর্তী, মুহম্মদ আনযাম, বাহাদুর আলী সরকার ও মুহম্মদ আনযাম (২য় বার)। পঞ্চাশের দশকে নদতীরের ৯৫ শতাংশ জমিতে বিদ্যালয় সম্প্রসারণ করা হয়। বিদ্যালয়ের নিয়মশৃঙ্খলা, লেখাপড়ার মান ও আনুসঙ্গিক কার্যাবলীর জন্য এটি তত্কালীন নাটোর মহকুমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে সরকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। এখানে দুইটি একতলা ভবন, ছয় কক্ষ বিশিষ্ট একটি ছাত্রাবাস ও একটি দ্বিতল ভবন নির্মিত হয়। একটি মানসম্মত উচ্চ বিদ্যালয় হিসাবে সাবেক মহকুমা সদরে অবস্থিত এই বিদ্যালয়টি সরকারি নীতির আওতায় ১৯৬৮ সালের ১ মে হতে প্রাদেশিকরণ বা সরকারি হয়। তখন এই বিদ্যালয়ের নামকরণ হয় নাটোর সরকারি জিন্নাহ্ হাইস্কুল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে এর
নাম হয় নাটোর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত প্রায় তিরিশ বছর জিন্নাহ্ মডেল হাইস্কুল বা নাটোর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ বা গৌরবাজ্জ্বল সময় বলা যায়। ঐ সময়ে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সুনামের সাথে বিদ্যালয় পরিচালিত হতো। তত্কালীন বিচক্ষণ প্রধান শিক্ষক আনযাম মীরপাড়া হতে বিদ্যালয় অন্যত্র স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে ১৯৬২ সালে বড়গাছা মৌজায় নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কের পার্শ্বে পর্যায়ক্রমে ৩.০৮ একর জমি ক্রয় করেন। অনেক চড়াই উতরাই-এর পর অবশেষে ১৯৭৬-৭৭ অর্থ বছরে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে সেখানে প্রথমে ছয় কক্ষ বিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন, প্রধান শিক্ষকের বাসভবন এবং শিক্ষকদের জন্য একটি ডরমিটরি ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে তৃতীয় হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শাখা বড়গাছার নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮০ হতে ১৯৯৮এর মধ্যে মূল ভবনকে সম্প্রসারিত করে ১৬ কড়্গ বিশিষ্ট দ্বিতল ভবনে রূপান্তরিত করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টির মোট একাডেমিক ভবন সংখ্যা ৩। প্রশাসনিক ভবন ২তলা বিশিষ্ট। একাডেমিক ভবন ১টি ৩ তলা এবং অপরটি ২তলা বিশিষ্ট। প্রশাসনিক ভবনে মোট কক্ষ ২০টি। এর মধ্যে ১টি প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষ, ১টি শিক্ষক মিলনায়তন, ১টি লাইব্রেরী, ৩টি বিজ্ঞানাগার, ১টি কম্পিউটার কক্ষ এবং অবশিষ্টগুলি শ্রেণীকক্ষ হিসাবে ব্যবহূত হয়। নিয়ম-শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, সততা, নেতৃত্ব, যোগ্যতা ইত্যাদি অর্জন করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা আলোকিত হয়েছেন তারা নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।