অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, কীটনাশকের ব্যবহার, নানা অবৈধ উপায়ে মত্স্য আহরণ, নদী-খাল-বিলে পানির গভীরতা কমে যাওয়ার কারণে চলনবিল অঞ্চলে গত ৩০ বছরে মাছের উত্পাদন ৬৩ শতাংশ হরাস পেয়েছে। বিলুপ্ত হয়েছে ২৫ প্রজাতির মাছ। জেলা মত্স্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ছোটবড় ৩১টি নদ-নদী। খালের সংখ্যা ৩৭টি। বিল রয়েছে ১৭টি। বিল ও নদীতে মত্স্য বিভাগের অভয় আশ্রম আছে ৩০টি। কিন্তু ঐসব নদী-খাল-বিল-অভয়াশ্রমের মাছ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একশ্রেণির নেতার সহায়তায় অবাধে ধরা হয়। মত্স্য সংরক্ষণ আইন না মেনে নিষিদ্ধ ঘোষিত সোঁতি ও কারেন্ট জাল দিয়ে ছোটবড় সব ধরনের মাছ ধরা হয়। এর ফলে একদিকে যেমন মা মাছ মানুষের খাদ্য হয়ে যায়, অপরদিকে ছোট মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পায় না।
চলনবিল এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড খাল খনন, বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণ করে। এর ফলে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হয়। মাছের চলাচল, প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট হয়। উচ্চ ফলনশীল ফসল উত্পাদনের জন্য আশির দশকে চলনবিল এলাকায় প্রায় সাত হাজার যন্ত্রচালিত নলকূপ বসানো হয়। এর ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নদী-খাল-বিলে পানির স্থায়িত্বকাল কমে আসে। ফসলের জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও বৃদ্ধি সরাসরি বাধাগ্রস্ত হয়। কারেন্ট, বাঁধাই, সোঁতি প্রভৃতি অবৈধ জাল দিয়ে অবাধে মাছ ধরা, মাছের প্রজননকালীন সময়ে গরিব মত্স্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রভাব, জেলেদের অজ্ঞতা, জলাশয় ভরাট করে নানা ভবন-স্থাপনা নির্মাণ প্রভৃতি কারণে চলনবিল অঞ্চলে মাছের উত্পাদন কমে গেছে। বিলুপ্তির পথে নান্দিনা, ভাঙ্গন, ঘোড়া, মহাশোল, তিলাশোল, ভ্যাদা, গজাড়, রেণুয়া, সরপুঁটি, রিঠা, বাছা, দেশি পাঙ্গাস, আইড় প্রভৃতি মাছ। তবে মত্স্য বিভাগ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাটোরে আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার ১৮ হাজার মত্স্যচাষির অধিকাংশই আধুকি পদ্ধতিতে মাছের চাষ করছেন। গত বছর জেলায় মাছের চাহিদা ছিল ২৭ হাজার ১৫০ টন। উত্পাদন হয়েছে ৩৩ হাজার ৮৮৬ টন। মাছের উত্পাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নাটোরে কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি পকল্পের আওতায় মত্স্যচাষিদের প্রশিক্ষণ, নার্সারি স্থাপন, জাল ও পিলেট মেশিন প্রদান, পানি পরীক্ষা, পরামর্শ ও মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়। এর জন্য ব্যয় হয় ৩১ লাখ টাকা। অর্থনৈতিক পশ্চাত্পদ এলাকার জনগণের জিবীকা নির্বাহ নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের আওতায় অভয়াশ্রম স্থাপন, পোনা অবমুক্তি, বিকল্প আয়বর্ধক কর্মসূচি, জলাশয় পুনঃখনন, সমিতি গঠন ও তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়। এর জন্য ব্যয় হয়েছে ১৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। প্রায় একই উদ্দেশ্যে ১২ লাখ ৩১ হাজার টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা হয় চিহ্নিত অবক্ষয়িত জলাশয় উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। অভিন্ন উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্প এবং অন্যান্য জলাশয় সমন্বিত মত্স্য ও প্রাণি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প। এর জন্য খরচ হয়েছে ৭৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। মাছে ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও গণসচেতনতা সৃষ্টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। প্রকল্পগুলি প্রায় এক এবং অভিন্ন। সুতরাং কোন্ প্রকল্পে কে উপকার ভোগ করছে, তা জানা কষ্টকর। এইসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়া সত্ত্বেও বাজারে মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না, দামও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে মত্স্য কর্মকর্তারা জানন, নানা সমস্যার কারণে মাছের উত্পাদন আশানুরূপ হচ্ছে না। মত্স্য অধিদপ্তরে দক্ষ জনবলের অভাব, মাছের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণে গবেষণার অভাব, অপ্রতুল বাজেট, মত্স্যচাষি ও মত্স্যজীবীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হয় না। বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুত্ বিল আদায় করা হয়। কৃষিজমির খাজনা প্রতি শতাংশ দুই টাকা, অথচ পুকুরের খাজনা ১৫ টাকা। জেলা মত্স্য কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম জানান, নদী-খাল-বিল-জলাশয়ের ব্যবস্থাপনা ভূমি মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে মত্স্য মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর, উন্মুক্ত জলাশয়ে মত্স্য সংরক্ষণ ও আহরণে স্থানীয় মত্স্যজীবী ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্তকরণ, খননকৃত সরকারি জলাশয়ের দশ শতাংশ অভয়াশ্রম হিসেবে ব্যবহার করলে মাছের উত্পাদন কয়েকগুণ বাড়বে।