'ছবি তুলে কি হবে ? এসব করে কি লাভ ? কত জনের কাছেই কষ্টের কথা কইছি। আমার মা গত বছর মারা গেছে। সেও তো কম চেষ্টা করেনি বাবার নাম সরকারের খাতায় তোলার। কই আপনেরা কেউই তো সে কাম করেননি। আমার বাবা চুরি-মালার (মনোহারী) ব্যবসা করতো। সুন্দর একটা সংসার ছিল। বাবা মরায় সব শ্যাষ হয়ে যায়। ছোট ছোট ৫ছেলে মেয়ে নিয়ে মা পরের বাড়ি কাজ করে খায়। কেউ দেখে নি'। লালপুরের ওয়ালিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে রান্নার কাজ করতে করতে কথা গুলো বলছিলেন ময়না যুদ্ধে শহীদ বকস সরদারের বড় মেয়ে উপহার খাতুন। তার স্বামী সেতু থেকে পড়ে ৭বছর ধরে পঙ্গু। ২ ছেলে ২ মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে অতি কষ্টে দিন কাটে তার। মাসিক মাত্র ১হাজার টাকায় পুলিশ ফাঁড়িতে রান্নার কাজ করেন তিনি।ময়না যুদ্ধে শহীদ ডাঙ্গাপাড়া চিলানের আব্দুল গফুরের স্ত্রী ফাতেমা বেওয়া(৭০) অসুস্থ। ওষুধ কেনার টাকা না পেয়ে শয্যাশায়ী। তার নাতি রেজাউল হক জানান, দাদীর শেষ ইচ্ছা দাদা যেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পান। ময়না গ্রামের শহীদ মসলেম আলী মোল্লা ও কাশেম আলী মোল্লার বোন সানোয়ারা বেগম, শহীদ সৈয়দ আলী মোলস্নার পুত্র অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, ওয়ালিয়া গ্রামের খায়রুল আনাম সাত্তারের পুত্র অধ্যাপক একেএম আব্দুস সবুরসহ সকল শহীদ পরিবারের সদস্যের একই দাবি।ময়না যুদ্ধে আহত প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুস সামাদ(৬৭) জানান, 'পাক হানাদার বাহিনীর আসার খবর পেয়ে ইছামতি নদীর বামনগ্রাম-বিজয়পুর ব্রিজের মুখে রাস্তা কেটে গর্ত করে পালাতে গিয়ে মসলেম, সাত্তার, কাশেম, কিয়ামত, অনিল, সেকেন্দার, আয়েজ ও আমি পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। তারা আমাদের উপর নির্যাতনের পর ময়না গ্রামের একটি আম গাছের সাথে বেঁধে গুলি করে। আমার কোমরে গুলি লাগে। দুই বার অপারেশন করতে হয়েছে। এতে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি। অনিল ছাড়া অন্যদের বুকে গুলি লাগায় সাথে সাথেই মারা যান। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও লাভ হয়নি।' ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ নাটোরের লালপুর উপজেলার রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে ময়না গ্রামে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে মুক্তি পাগল জনতা, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর হাতে পাক হানাদার বাহিনীর ২৫ রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়ে যায়। পরদিন সকালে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা হানাদার বাহিনীর সদস্যসহ তাদের নেতৃত্ব দানকারী মেজর জেনারেল আসলাম হোসেন খান ওরফে রাজা খান ধরা পড়লে লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট হাইস্কুল মাঠে এনে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ঐ যুদ্ধে এলাকার অন্তত: ৩৫ জন বাঙালি শহীদ হন। এই যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘটলেও যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী যোদ্ধারা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি। তাদের পরিবারের অনেকেই এখনও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শহীদদের কয়েকজন হলেন, সৈয়দ আলী মোল্ল¬া, মসলেম আলী মোল্লা, আবুল কাশেম মোল্লা, আয়েজ উদ্দীন মোল্লা, খন্দকার নুরুন্নবী মন্টু, কেরামত আলী শেখ, খায়রুল আনাম সাত্তার, আবেদ আলী। ময়নার যুদ্ধস্থলে নিহতদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে শহীদ স্মৃতিসৌধ। প্রতিবছর ৩০মার্চ এখানে দিবসটি পালিত হয়।