সিলেটে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাসদ আয়োজিত সমাবেশে ছাত্রলীগের হামলা শুধু যে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়াছে তাহাই নহে, নিশ্চিতভাবে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রাখিয়া দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব যখন হারানো জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের জন্য কঠিন পরিশ্রম করিয়া যাইতেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী হইতে পারে— তাহা অনুমান করা কঠিন নহে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে তর্কবিতর্ক— এমনকী হাতাহাতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নহে। দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে তাহা আবার মিটমাটও হইয়া যায়। এই ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটিলে আমরা স্বস্তিবোধ করিতাম। কিন্তু সিলেটের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেইখানে উপর্যুপরি হামলার ঘটনা ঘটিয়াছে। উচ্ছৃঙ্খল ও উদ্যত হামলাকারীদের নিরস্ত করিতে র্যাব-পুলিশকেও হিমশিম খাইতে হইয়াছে। এমনকী সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও রক্ষা পান নাই তাহাদের তাণ্ডব হইতে। অতএব, হামলার কারণ হিসাবে যতো যুক্তিই দেখানো হউক না কেন— ঘটনাটি যে অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয় তাহাতে সন্দেহ নাই। সর্বোপরি, ছাত্রলীগের এই অপরিণামদর্শিতার দায় যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই বহন করিতে হইবে, তাহাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
ছাত্রলীগ নামধারী কিছু নেতাকর্মী-সমর্থকের সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ইহাই প্রথম নহে। বস্তুত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসিবার পর হইতেই ইহা চলিয়া আসিতেছে। খোদ দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপর্যুপরি হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন যে ঘটে নাই— সিলেটের ঘটনাই তাহার অকাট্য উদাহরণ হিসাবে বিবেচিত হইতে পারে। অবশ্য বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই ধরনের বাড়াবাড়ির ঘটনা অপ্রতাশিত বা নূতন কিছু নহে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শাসনামলে ছাত্রদলের আচরণও ভিন্ন ছিল না। ইহা অনস্বীকার্য যে, যখন যাহারা ক্ষমতায় আসিয়াছেন তাহাদের নেতাকর্মী-সমর্থকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বেপরোয়া হইয়া উঠিয়াছেন। চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়াছেন আইন-কানুন নিয়মনীতির প্রতি। অতএব, ক্ষমতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ই যে সকল নষ্টের মূল— তাহা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। অতিশয় উদ্বেগের বিষয় হইল, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রতিপালিত প্রশাসন শুধু যে তাহাদের আইনানুগ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না তাহাই নহে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাহারা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সীমালঙ্ঘনকারীদের মোসাহেবের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হইয়া থাকেন। ফলে সরকার বদল হইলেও পরিস্থিতি বদলাইতেছে না। পূরণ হইতেছে না জনগণের গণতান্ত্রিক সুশাসনের দীর্ঘলালিত প্রত্যাশা।
স্বস্তির বিষয় হইল, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এইবার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়াছেন। তাত্ক্ষণিকভাবে সংগঠনের সিলেট জেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হইয়াছে। সংবাদ সম্মেলন করিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করা হইয়াছে এই 'অনাকাঙ্ক্ষিত' ঘটনার জন্য। একই সাথে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধও জানানো হইয়াছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট। ছাত্রলীগ নেতৃত্বের এই ইতিবাচক মনোভাব নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এই ধারা অব্যাহত থাকিলে রাজনীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যাবত্ বিরাজমান চরম অসহিষ্ণুতার বিপরীতে কিছুটা হইলেও যে স্বস্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হইবে তাহা নিশ্চিতভাবে আশা করা যায়। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইল, এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রশাসনকে অবশ্যই আরও তত্পর হইতে হইবে। যতো শীঘ্র সম্ভব দায়ী ব্যক্তিদের দাঁড় করাইতে হইবে বিচারের কাঠগড়ায়।