
১৯৬৩ সালে ছাগলনাইয়াতে একটা প্রচীন পাথুরে হাতিয়ার বা হাত কুঠার আবিষ্কার হয়। বর্তমানে এটা ঢাকা জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এ হাতিয়ার প্রত্নপ্রস্তর যুগের অর্থাত্ এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন। হাতিয়ার আবিষ্কারের ফলে আমরা অনুমান করতে পারি, পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছাগলনাইয়া অঞ্চলে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও মানুষের পদচারণা ছিল। পন্ডিতদের মতে আদিকালে মনুষ্য বসতির জন্য উপযুক্ত স্থান িঁছল পাহাড়ের পাদদেশে ও সাগরের তীরভূমি। বর্তমানে ছাগলইনায়া অঞ্চলে কোন সাগর না থাকলেও অতীতে যে ছিল না এমন কথা বলা যায় না। পন্ডিত ব্যক্তিরা মনে করেন, দূর অতীতের কোন এক সময় সমগ্র গাঙ্গেয় বদ্বীপ সাগর গর্ভে বা জলাভূমিতে ডুবে ছিল। কারো কারো মতে বং নামক একটা প্রাচীন চৈনিক শব্দ থেকে বঙ্গ শব্দের উত্পত্তি হয়েছে। বং শব্দের অর্থ হচ্ছে জলাভূমি। বর্তমানে আমরা দক্ষিণ পূর্ব বাংলার যে ভৌগলিক অবস্থান দেখতে পাই তা হাজার হাজার বছরের প্রাকৃতিক পরিবর্তন ভূমিকম্প, নদনদীর ভাঙ্গাগড়া স্রোতধারার গতি পরিবর্তন ও উঁচু পাহাড়িয়া এলাকার মাটি জমে গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ পূর্ব বাংলার প্রাচীন সমতট রাজ্যের পূর্বভাগে অবস্থিত আধুনিক ফেনী ও তত্সংলগ্ন জনপদ কখন কীভাবে জলা থেকে ডাঙ্গায় পরিবর্তন হয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা দূরুহ কাজ। মহাভারতে বর্ণনা অনুযায়ী ধারণা করা হয়, বংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বা বরেন্দ্রভূমিতে যখন প্রথম জনবসতি শুরু হয়েছিল তখনও দক্ষিণ পূর্ব বাংলার অধিকাংশ অঞ্চল ছিল জলমগ্ন অর্থাত্ একটানা ভূখন্ড গড়ে উঠেনি। প্যারীপ্লাসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, গঙ্গা নদীর পূর্বভাগে যতটুকু ডাঙ্গা বা স্থলভূমি ছিল তাতে কিরাত নামে এক জাতি বাস করত। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ সিরাজুল হকের মতে, তত্কালে কিরাত আলয় বলতে বর্তমানে সিলেটের দক্ষিণাংশ, কুমিল্লার পূর্বাংশ, ফেনী নোয়াখালী, পার্বত্য ত্রিপুরা ও পার্বত্য চট্রগ্রামকে বুঝাত (বাংলা একাডেমি পত্রিকা পৌষ-চৈত্র, ১৩৬৭ বাংলা)।
স্থানীয় কিংবদন্তী সূত্রে প্রকাশ আধুনিক ছাগলনাইয়ার আদি নাম ছিল সাগর নাইয়া। কাজীরবাগের উচ্চভূমি থেকে পূর্বদিকে পার্বত্য ভূমির মধ্যভাগে ছিল এক সময় এক বিরাট সাগর। কেউ কেউ ওটাকে সুখ সাগর নামে অভিহিত করেন। এখানে ফেরি পারাপরের জন্য ছিল নাইয়া বা নৌকার মাঝি। সাগর ও নাইয়া শব্দদ্বয় যুক্ত হয়ে সাগর নাইয়া নাম কালের বিবর্তনে ছাগলনাইয়া শব্দে পরিণত হয়েছে। ছাগলনাইয়া অঞ্চলে পুকুরাদি খনন করার সময় কোথাও কোথাও কিছু নৌকার ভগ্নাবশেষ আবিষ্কার থেকে পন্ডিতগণ মনে করেন ঐ অঞ্চলে দূর অতীতের কোন এক সময় নিম্ন জলাভূমির সাথে সাদৃশ্য ছিল।
আধুনিক ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের বিরাট অংশ নদ নদীর গতি পরিবর্তন ও ভূতাত্বিক পরিবর্তনের ফলে যে ডাঙ্গায় পরিণত হয়েছে সে সম্পর্কে আরো তথ্য পাওয়া যায়। স্থানীয় জনশ্রুতির উল্লেখ করে ড: আহমদ শরীফ ইতিহাস পএিকায় লিখেছেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে লালমাই পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এক সমুদ্র ছিল।
ভুলুয়া ও যোগদিয়া ছিল তখন দ্বীপের মত। ফেনী অঞ্চলছাড়া নোয়াখালীর অন্যান্য অংশ ছিল সমুদ্র গর্ভের। মৃত্তিকার গঠন প্রণালী থেকে পন্ডিতগণ মনে করেন, নোয়াখালীর পশ্চিম দক্ষিণাংশ অপেক্ষা ফেনীর পূর্বাঞ্চল অধিক প্রাচীন। চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সপ্তম শতাব্দীতে সমতট রাজ্যের রাজধানী কুমিল্লার কর্মন্ত বসাক ভ্রমণকালে সিলেট জেলার প্রায় এক চতুর্থাংশ জলমগ্ন এবং কুমিল্লা নোয়াখালী অঞ্চলে প্রায় দুই হাজার বর্গমাইল ব্যাপী এক বিশাল হরদ বা জলাভূমি দেখেছেন, (চট্রগ্রামের ইতিহাস, মাহবুব আলম)।
আধুনিক ফেনীতে উঁচুভূমি বলতে কাজিরবাগের পোড়ামাটির পাহাড়িয়া এলাকা উল্লেখযোগ্য। লালচে মাটি বিশিষ্ট পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ফেনী বিলোনীয়া রেলপথ গিয়েছে। লালমাটি বা পোড়ামাটির পাহাড়িয়া এলাকাটিকে স্থানীয়ভাবে সিরাজ শহর বলা হয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী অতীতে এখানে কোন রাজবংশের বসতবাড়ি ও দুর্গ ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বহিরাক্রমণের ফলে এখানকার পোড়ামাটির তৈরি রাজপ্রাসাদ ও দুর্গ ধুলিস্যাত্ হয়ে যায়।
নোয়াখালী ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার থেকে জানা যায় যে, উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে ওখানে আবার প্রাকৃতিক নিয়মে নতুন চরাঞ্চল জেগে উঠতে থাকে। আধুনিক ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চল জলা থেকে ডাঙ্গায় রূপান্তরিত হওয়া সম্পর্কে ১৮৬৩ সালে একজন লিখেছেন, আনুমানিক একশত বছর পূর্বেও নোয়াখালী জেলার উওরাংশ এবং কুমিল্লা জেলার কোন কোন এলাকা নিঁচু ও জলাভূমি সদৃশ ছিল। ভূ আলোড়ন ও নদনদীর প্রবাহের ফলে উক্ত স্থানসমূহ সমতল ভূমির আকার ধারণ করেছে (বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার ১৯০১ খৃ:)।
কোন কোন পন্ডিত ব্যক্তির মতে কালিদাসের বর্ণিত তালীবন সন্নিবেশে শ্যামবর্গ পূর্ব মহোদধির বেলাভূমি বলতে তিনি সাগরতীরের ভূমি কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বরিশাল অঞ্চলকে ইঙ্গিত করেছেন। আবহমান কাল থেকে কুমিল্লা নোয়াখালীর তাল গাছের সমারোহ সে ইঙ্গিতের সম্পূূরক বলা চলে। কালিদাসের সময়কাল নিয়ে পন্ডিতগণের বিতর্ক এখনও চলছে। পন্ডিতদের মতে গৌতম বুদ্ধের স্মরণে নির্মিত ঐ শিলামূর্তি ভূমিকম্প বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভেঙ্গে পড়েছে। বর্তমানে ঐ শিলামূর্তির ভগ্নাবশেষ ১৯০৮ সালের প্রত্নতাত্বিক সংরক্ষণ আইন দ্বারা সংরক্ষিত রয়েছে। স্থানীয় জনশ্রুতিতে প্রকাশ শিলামূর্তিটি আবিস্কারের ফলে ঐ জনপদের নাম শিলা বা শিলুয়া বলে নামকরণ হয়েছে। এআলোচনা থেকে আমরা আধুনিক ফেনী নামে পরিচিত ভুখন্ড ও তত্সংলগ্ন পত্তনের ক্রম পরিবর্তন এবং জনজীবনের বিকাশ ও আদি মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একটা রুপরেখা পাই।
(প্রবন্ধের লেখক মরহুম জমির আহমেদ ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়নের দৌরতপুর গ্রামের আদিবাসী। তার রচিত ফেনীর ইতিহাস বইটি বহুল প্রশংসিত হয়েছে। এ লেখাটি ফেনীর ইতিহাস বই থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে সংকলিত)