
দেওয়ানগঞ্জের পরিচয় দিতে গিয়ে ফেনীর প্রতিষ্ঠাতা মহকুমা প্রশাসক কবি নবীন চন্দ্র সেন লিখেছেন, 'দেওয়াগঞ্জ বলিতে একটা ক্ষুদ্র ভরাট দীঘির পাড় মাত্র। তাহাতে একটা ক্ষুদ্র বাজার ও ঘরে ঘরে থাকা গরুর ঘরের মতো মুন্সেফে অফিস ও উকিল আমলার ঘর। ভরা পুস্করিনীটির উপর তাঁহাদের পায়খানা এবং উহা তাঁহাদের মক্কেলদের মলমূত্র পুরিত।' সেই দেওয়ানগঞ্জ আজ শুধু ইতিহাস, বিস্মৃত ইতিহাস। ইতিহাসের কোন স্মৃতিচিহ্ন দেওয়ানগঞ্জে নেই। দেওয়ানগঞ্জের সেই ঐতিহাসিক দীঘিটিও নেই। কালের করাল গ্রাসে আজ সব বিলুপ্ত। তত্কালীন নোয়াখালীর অন্যতম মুন্সেফ কোর্ট ছিল দেওয়ানগঞ্জ মুন্সেফ কোর্ট। ১৮৭২-৭৩ সালের দিকে জনসংখ্যা কম (১৫ লক্ষের নিচে) অজুহাত দেখিয়ে ব্রিটিশ সরকার তত্কালীন নোয়াখালী জেলা বিলুপ্ত করার একটি পরিকল্পনা করে। তাতে নোয়াখালীর মানুষ ঘোর আপত্তি ও প্রতিবাদ জানাতে থাকে। 'ঢাকা প্রকাশ' পত্রিকায় এতদসংক্রান্ত ঘোর আপত্তি ও প্রতিবাদ জানিয়ে নোয়াখালীর সংবাদদাতা চিঠি লেখেন। ০৭/০৫/১৮৭৪ তারিখে লেখা একপত্রে আপত্তি ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি পরামর্শও দেয়া হয় এই বলে যে, নোয়খালী জেলা বিলুপ্ত না করে অন্ততঃ এটাকে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর জেলা হিসেবে রাখা হোক। নোয়খালীকে নোয়াখালী সদর, চরপাতা ও দেওয়ানগঞ্জ মহকুমা সমান ভাগ না করে নোয়াখালীকে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর জেলারূপে হলেও জেলাই রাখা হোক বলে পরামর্শ দেয়া হয়। পরে ব্রিটিশ সরকার পূর্ব পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। ১৮৭৫ সালে রাজাঝির দীঘির পাড়ে অস্থায়ীভাবে ফেনী মহকুমা অফিস নির্মাণ করা হয়। এ মহকুমাটি স্থাপিত হয়েছে নবীন চন্দ্র সেনের প্রচেষ্টায়। এ সম্পর্কে তাঁর উক্তি, 'আমার চেষ্টায় সাব-ডিভিশন খোলা হয় এবং এই স্থানটি নির্বাচিত হয়'। মহকুমা প্রতিষ্ঠাকালে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম ডিভিশনাল কমিশনারের পার্সোনাল এ্যাসিস্টেন্ট। পরে তিনি নোয়াখালী সদরে বদলী হন। ফেনী মহকুমা প্রতিষ্ঠার আট বছর পরে ১৮৮৩ সালে তিনি নোয়াখালী হতে গরুর গাড়িতে এসে ফেনী মহকুমার এস.ডি.ও পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এখানে একনাগাড়ে প্রায় নয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মনে করেছিলেন তাঁর পূর্ববর্তী সময়ে কর্মরত এস.ডি.ও এতদিনে ফেনী মহকুমাকে একটা আকার দিয়েছেন। কিন্তু কিছু হয়নি দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়লেন, 'ধান্যক্ষেত্র প্রবেষ্টিত এই স্থান। হাট-বাজার পর্যন্ত আড়াই মাইলের মধ্যে নাই। কেন এমন স্থানে সাধিয়া আসিলাম, স্ত্রী ভর্ত্সনা করিতে লাগিলেন। আমার মনেও অনুতাপ হইল।' এই হতাশা অতিসত্ত্বর ঝেড়ে ফেলে তিনি ফেনী মহকুমা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি প্রথমে ফেনীতে হাট বসানোর উদ্যোগ নেন। তাঁর পূর্ববর্তী এস.ডি.ও ত্রিপুরার মহারাজার তিন হাজার টাকা ব্যয় করে বর্তমান ফেনী বাজারে হাট বসালেন, সেখানে একটি পুকুরও খনন করালেন (বর্তমানে পুকুর ভরাট করে 'ফেনী নিউ মার্কেট' নির্মাণ করা হয়েছে)। কিন্তু তিনদিকে তিনটি নিয়মিত ও বড় বাজার থাকায় ফেনী হাট টিকল না। নবীন চন্দ্র মুন্সেফীসহ দেওয়ানগঞ্জ হাট উঠিয়ে অন্যের কথা চিন্তা করলেন। তাঁর পূর্ববর্তী এস.ও.ডি. দেওয়ানগঞ্জ মুন্সেফী তুলে আনতে গিয়ে মামলার শিকার হন। রায়ে তিনি পরাস্ত হন। ফলে মুন্সেফী দেওয়াগঞ্জেই থেকে যায়। নবীন চন্দ্র এসব ঘটনার আলোকে মুন্সেফকে হাত করেন। এবার মুন্সেফকে দিয়ে জেলা কালেক্টরের কাছে মুন্সেফী পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাব পাঠান। জেলা কালেক্টর তদন্ত করতে এসে পরিবর্তন বিরোধী উকিল-মোক্তার-আমলারা তাঁকে কলাগাছ পুঁতে গেট দিয়ে অভ্যর্থনা জানান ও পরিবর্তনের বিপক্ষে যথাসাধ্য বোঝালেন। তাতে তিনি মুন্সেফী পরিবর্তনের বিরোধীদের মতই গ্রহণ করেন। এতে উকিল-আমলারা খুব উল্লসিত হলেন। নবীন চন্দ্র দমবার পাত্র নন। তিনি এবার ফেনী হাট প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন। দোকান নির্মাণ, জালজীবী ও অন্যান্য ব্যবসায়ীকে দ্রব্যের জন্য কিছু কিছু অগ্রিম দেন। 'হাট কমিটি' করে দেন। মহারাজার মোক্তারের টাকায় অবিক্রিত দ্রব্যাদি ক্রয় করান। দেওয়ানগঞ্জ হাটে যাওয়ার সময় লোকজনকে পথে পথে কৌশলে পুলিশ দিয়ে বাধা দেন ও প্রচার করেন যে, ফেনী হাটে সব কিছু পাওয়া যায়। বিরোধীতাকারীদেরকে পুলিশ ও মামলার ভয় দেখান। এর ফলে দেওয়ানগঞ্জ হাট পড়ে যায়; জমতে থাকে ফেনী হাট— আজকের 'ফেনী বাজার'। ফেনীতে কৌশলে হাট-বাজার মিলতে থাকল। এবার দেওয়ানগঞ্জ থেকে মুন্সেফ কোর্ট ফেনীতে আনার চেষ্টা শুরু করলেন নবীন চন্দ্র সেন। জেলা কালেক্টর যেহেতু বিপক্ষে সেহেতু তিনি তাঁকে ছেড়ে জনসাধারণের পক্ষে মুন্সেফ কোর্ট উঠিয়ে ফেনীতে আনার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আবেদনপত্র পাঠাতে শুরু করেন। হাইকোর্ট জজ (বিচারক) গণের মত চাইলে তিনি ফেনী সফর করেন। জেলা কালেক্টর বিপক্ষে থাকলেও বিভাগীয় কমিশনার লয়েল (Loyal) পক্ষে ছিলেন। অবশেষে জজগণ ফেনীতে মুন্সেফ কোর্ট উঠিয়ে আনার পক্ষে রিপোর্ট দিলেন। উকিল-মোক্তার-আমলারা জনসাধারণ ও নিজেদের নামে হাইকোর্টে ও সরকারে অনেক দরখাস্ত করলেন যাতে কোর্ট স্থানান্তরিত না করা হয়। আসলে মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ছাড়া সবাই চেয়েছিল সমস্ত অফিস ফেনীতে এক স্থানে একত্রিত হোক। হাইকোর্ট যথাসময়ে সরকারের সম্মতিক্রমে মুন্সেফ কোর্ট দেওয়ানগঞ্জ হতে ফেনীতে আনার আদেশ দিল। এ আদেশে সমস্ত ফেনী বিভাগের লোক আনন্দে নাচতে লাগল। দিনটি ছিল দুর্গাপূজার বন্ধের পূর্ব দিন। পরের দিন সকালে কোর্ট আনার জন্য সর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন নবীন চন্দ্র। অসংখ্য গরুর গাড়ি সংগ্রহসহ চারদিক লোকজনকে খবর দেয়া হল। এরপর দেওয়ানগঞ্জ থেকে কোর্ট ফেনীতে উঠে এল। সেই উঠে আসার দৃশ্য নবীন চন্দ্র সেনের স্মৃতিকথা থেকে উদ্ধৃত করছি:'পরদিন প্রাতে দেওয়ানগঞ্জে প্রায় পঞ্চাশখানা গাড়ি ও পাঁচশত মজুর সমবেত। যাহারা কখনো মজুরি করে নাই, তাহারাও গিয়াছে। লোকের আর আনন্দ ধরে না। তামাসা দেখিবার জন্য শত শত লোক উপস্থিত। নিকটস্থ সমস্ত গ্রাম লোকশূন্য হইয়াছে। অনুমান আটটার সময়ে আমার গৃহের পশ্চাতের চৌবারান্দায় বসিয়া স্বামী ও স্ত্রী দেখিতেছি, প্রথম গরুর গাড়ির ট্রেনে কাচারীর জিনিসপত্র— এমনকি, ঘরের বেড়া ও খুঁটি ইত্যাদি আসিতেছে। তাহার পর বড়ই কৌতুক দৃশ্য!— এক একখানি আস্ত ঘর যেন হাঁটিয়া আসিতেছে এবং হরিধ্বনিতে গগন বিদীর্ণ হইতেছে। এত লোক জুটিয়াছে যে, ঘরের চারিখানি চাল না খুলিয়া, লোক কাঁধে করিয়া লইয়া আসিতেছে। দূর হইতে দেখিতে চারি চালের নীচে চারি সারি লোক যেন সজীব খুঁটি বোধ হইতেছে। ঘর যেন হাঁটিয়া আসিতেছে। এ দৃশ্য কেহ কখনো দেখে নাই। রাস্তার দুই ধারে লোকারণ্য। গৃহ সকল এরূপ হাঁটিয়া যাইতেছে দেখিয়া নর-নারী বদর ধ্বনিতে চারদিকে প্রতিধ্বনি তুলিয়া দেওয়ানগঞ্জের মুন্সেফী এরূপে ফেনীতে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং সেই দিনই দিনে দিনে গৃহাদি ফেনী দীঘির পূর্ব পাড়ে উঠাইয়া ও তাহাতে জিনিসপত্র সজ্জিত করিয়া আমি ও মুন্সেফ উভয়ে জজের কাছে টেলিগ্রাফ করিলাম।'
এরপরও বিরোধিতা অব্যাহত থাকে। উকিল আমলাদের জন্য ফেনী বাজারের বিপরীতে ট্রাংক রোডের পাশে উচিত খাজনামূলে জমি বন্দোবস্ত দিলেন। কিছুদিন পর দেওয়ানগঞ্জ 'পরিদর্শন বাংলো' পূর্ত বিভাগ থেকে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে ন্যাস্ত হলে তিনি সেটি ফেনী দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় স্থাপন করেন এবং বাংলো ও এস.ডি.ও কাছারীর মধ্যস্থলে সুগন্ধ পুষ্পের বকুল, নাগেশ্বর, চম্পক, কদম্ব প্রভৃতির গোল স্তবক রোপন করেন। দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় মাঠে বাঁশের নির্মিত জেলখানা পাকা করেন, কিছুদিন পরে দীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি পাকা ট্রেজারিও নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, আমিরগাঁও থানাটিও অল্প পূর্বে খাইয়ারা থেকে ফেনী দীঘির পশ্চিম পাড়ে ' ফেনী থানা' নামে স্থানান্তরিত হয়। দীঘির পূর্বদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের পূর্ব পাশের মাইনর স্কুলটিকে তিনি মিডল ইংলিশ হাইস্কুলে উন্নীত করেন। ঢাকা চট্টগ্রাম-মহাসড়কের পশ্চিম পাশের ডিসপেনসারিটি সংস্কার করেন। রাজাঝির দীঘির চতুষ্পাশ মাটি কেটে নীচু করেন ও দীঘি সংস্কার করেন। এসব কাজের ফলে 'দেখিতে দেখিতে ফেনী একটি সুন্দর উপনগর হইয়া উঠিল।' নবীন চন্দ্র সেনের পূর্বে এক বা একাধিক মহকুমা প্রশাসন দায়িত্ব পালন করলেও নবীন চন্দ্র সেনই ফেনীর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
লেখক : আবু হেনা আবদুল আউয়াল
কবি ও ফ্রিল্যান্স সংবাদকর্মী