ফেনী কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসঃ জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেনী সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠার গোড়াপত্তন শুরু হয় ১৯১৮ সালে। খান বাহাদুর বজলুল হকের নেতৃত্বে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে আজ থেকে প্রায় ৯১ বছর পূর্বে ১৯২২ সালে ফেনী সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ফেনী সরকারী কলেজ বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল ও ছাত্র- ছাত্রীর সংখ্যার বিচারে শুধু ফেনী জেলারই নয়—বৃহত্তর নোয়াখালী তথা দক্ষিণ—পূর্ব বাংলার প্রথম ঐতিহ্যবাহী কলেজে পরিণত হয়েছে।
এই কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় আরো যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, মহেন্দ্র কুমার ঘোষ, কালীচরণ নাথ, এনায়েত হাজারী, কলেজ প্রতিষ্ঠানকালীন অধ্যক্ষ বীরেন্দ্র ভট্টাচার্য এবং তত্পরবর্তী অধ্যক্ষ অম্বিকাচরণ রক্ষিত রায়বাহাদুর। কলেজটি জাতীয়করণ হয় ৭ মে ১৯৭৯ সালে এবং অনার্স কোর্স চালু হয় ১৯৯৭ সালে।
ফেনী সরকারী কলেজের বর্তমান অবস্থা
ফেনী সরকারী কলেজে বর্তমানে ১৬টি বিষয়ে অনার্স কোর্স ও ৪টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স রয়েছে। এই কলেজে বর্তমানে অধ্যয়নরত ছাত্র- ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার। ২০১২ সালে এইচ.এসসিতে গড় পাশের হার ছিল ৮২.৩১% এবং জি.পি.এ- ৫ পেয়েছে ১০৭ জন । তাছাড়া কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে মেধাতালিকায় ১১তম স্থান লাভ করে। ২০১৩ সালে এইচ.এসসি তে গড় পাশের হার ছিল ৮৩.৪৭% এবং জি.পি.এ- ৫ পেয়েছে ১৩২ জন। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান লাভ করে।
কলেজের বিভিন্ন সমস্যা
বর্তমানে ফেনী সরকারী কলেজে প্রায় ১৬ হাজার ছাত্র—ছাত্রী অধ্যয়ন করলেও তাদের জন্য কলেজে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল শ্রেণী কক্ষের স্বল্পতা। শ্রেণী কক্ষে নিয়মিত পাঠ দানের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। ৭টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়েছে ১৯৯৭ সালে অথচ প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হয়নি। আবার সৃষ্ট পদও বহুদিন খালি পড়ে রয়েছে। ছাত্রদের জন্য কয়েক বছর আগে একটি ছাত্রাবাস নির্মিত হলেও দূর-দূরান্ত থেকে আগত ছাত্রীদের জন্য কোন ছাত্রী নিবাসের ব্যবস্থা নেই। কলেজটি সরকারী হলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মচারীর পদ সৃষ্টি হয়নি। ফলে অতি প্রয়োজনীয় কিছু কর্মচারী মাস্টার রোল ভিত্তিতে নিয়োজিত রয়েছেন।
অনিয়মই যে প্রতিষ্ঠানের নিত্যদিনের নিয়ম
অধিকাংশ শিক্ষক সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন কলেজে আসেন। বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা কলেজে নিয়মিত অনুপস্থিত থাকার কারণে বিভাগের শ্রেণী কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা যায় গণিত, হিসাবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, সমাজকর্ম, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও দর্শণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা সপ্তাহে ২/১ দিন কলেজে আসেন। আবার অনেকে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর এক দিন কলেজে আসেন। কলেজে কর্মরত একজন কর্মচারী অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান অধ্যক্ষ কলেজে যোগদানের পর থেকেই দফায় দফায় সেসন ফি, কম্পিউটার ফি সহ অন্যান্য ফি বাড়িয়ে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে তা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে ভূয়া বিল ভাউচার বানিয়ে এক শ্রেণীর হেভিওয়েট শিক্ষকের সহায়তায় আত্মসাত্ করে যাচ্ছেন। যার কারণে তিনি শিক্ষকদের নিয়মিত কলেজে আসতে বলেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, অধ্যক্ষ, কলেজের হিসাব রক্ষক ও প্রধান করণিককে নিয়ে ৭০০% বেশি দাম দেখিয়ে ইউনিক সাইন্টিফিক নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে গত ৩ বছর বিজ্ঞান সরঞ্জাম ক্রয় করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাত্ করেছেন। এছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের নিকট থেকে বিজ্ঞান গবেষণা ও লাইব্রেরির বই ক্রয়ের নামে আদায়কৃত টাকা বিভিন্নভাবে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। অধ্যক্ষ ডিগ্রি ও অনার্স ফরম ফিলাপের সময় ছাত্র প্রতি অতিরিক্ত ৫০ টাকা করে ৬ হাজার ছাত্র/ছাত্রীর নিকট প্রায় ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে তা কলেজের কর্মচারীরা সহ ভাগভাগি করে নেন। ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া একজন ছাত্র অভিযোগ করে বলেন, আমার মার্কশিট ও প্রশংসাপত্র আনতে কলেজ অফিসে গেলে অফিসের একজন কর্মচারী ৩ দিন অতিবাহিত করে ১০০ টাকার বিনিময়ে উপরোক্ত কাগজগুলো প্রদান করে। কলেজ অফিসে অনুসন্ধান করে জানা যায়, অফিসে কর্মরত করণিকরা বদলি বাণিজ্য ও ভর্তি বাতিল, টাকার বিনিময়ে হারানো মার্কশিট, রেজিস্ট্রেশন কার্ডসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহ করে দেয়ার কাজে বেশি ব্যস্ত থাকে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীর কলেজ অফিস থেকে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে।
কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি শওকত ইমরান হাজারী বিপ্লব অভিযোগ করে বলেন, কলেজ হোস্টেল সুপারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক জয়নাল আবেদীন অর্থ আত্মসাত্ সহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়লে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে অধ্যক্ষ তাকে হোস্টেলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন। বর্তমানে হোস্টেলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরাই হোস্টেল পরিচালনা করলেও তাতে কলেজ কর্তৃপক্ষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এছাড়াও ফেনী কলেজের প্রধান ভবনটিকে ফেনী গণপূর্ত বিভাগ দশ বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও বর্তমানে প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ ছাত্রছাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ ভবনে ক্লাস করছে। এ ব্যাপারে কলেজ কর্তৃপক্ষের কোন মাথা ব্যথা নেই। কলেজে বিদ্যমান এ সকল অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অচিরেই এ কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে এবং ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হবে।
বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে অধ্যক্ষ উত্পল কান্তি বৈদ্যের সাথে কথা বলতে চাইলে তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।