মহাকবি নবীন চন্দ্র সেন শতবর্ষ আগে এ মহকুমার নিজ অবস্থানে থেকে সাহিত্যচর্চা করেছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফেনী এসে এক সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া সাহিত্যিক গোপাল হালদার ফেনী কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকে দেশ নন্দিত হয়েছেন হাবীবুল্লাহ, বাহার চৌধুরী, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, জহির রায়হান, শহীদুল্লা কায়সার, সেলিম আল দীন, বেলাল চৌধুরী, শামসুল ইসলাম ও এরশাদ মজুমদার প্রমুখ। এ কৃর্তী ও খ্যতিমান লেখকদের সাথে লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চায় সহযোগী হয়েছেন আরো অগণিত ব্যক্তিত্ব। যারা বিগত চার দশক ধরে সাহিত্যচর্চায় অবদান রেখেছেন তারাও আজ লেখার জগতে প্রতিষ্ঠিত। তাদের প্রচেষ্টায় সাফল্যের শিখরে আজ ফেনীর সাহিত্য সংস্কৃতির জগত্। তাদের সাফল্যে নতুনরাও আজ অনুপ্রাণিত।
ষাটের দশকে ফেনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'ফসল' শুধু সংবাদ বা নানামুখী খবরকে প্রাধান্য দেয়নি, কবিতা, সাহিত্যের উপস্থিতি ছিল পত্রিকার পাতায় পাতায়। পত্রিকার পাঠকদের জন্য ছিল সব উপকরণ, যা সকল শ্রেণীর পাঠকের আনন্দের খোরাক জোগাতো। ফলে পাঠক ও লেখকরা সাপ্তাহিক ফসলে লেখার সুযোগ পেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। পত্রিকা থেকে সহযোগিতা পেতো নতুন প্রজন্মের তরুণরাও। ফেনীতে এরশাদ মজুমদারের অনুপস্থিতি ও সাপ্তাহিক ফসলের প্রকাশনা ঢাকা থেকে শুরু হওয়ার কারণে তরুণ লেখকদের মাঝে দেখা দেয় হতাশা। এসময় ফেনীতে আরো কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকাগুলোর কয়েকটিতে সাহিত্যের পাতা ছিল।
গিয়াস উদ্দিন হায়দার এ সময় 'নির্ঝর' নামে একটি সাহিত্য মাসিক নিয়ে এগিয়ে আসেন। হায়দার কবি বা লেখক ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন সাহিত্যামোদী, সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক। ষাটের দশকের কবি সাহিত্যিকদের তিনি সংগঠিত করেছিলেন। উত্সাহ দিয়েছিলেন। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো সাহিত্য মাসিক 'নির্ঝর'। নির্ঝরে যারা লেখালেখির সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের অনেকেই আজ সাহিত্য তথা লেখার জগতে প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীকালে ফেনী থেকে ঢাকায় চলে যাওয়ার কারণে ফেনীতে লেখালেখির জগতে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়ে উঠতি লেখকরা। সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো বিশেষ দিবসে বা বর্ষপূূূূূর্তি সংখ্যায় সম্পাদকরা কবিতা, ছড়া ও ছোটগল্প ছাপতেন।
ষাটের দশকে ফেনীতে যারা সাহিত্য তথা কাব্যচর্চা করতেন তাদের মধ্যে জাহিদুল হক, আবুল কাশেম, মির্জা আবদুল হাই, রফিক রহমান ভূঁইয়া, মোতাসিম বিল্লাহ চৌধুরী, আনিসুল হক কানু উল্লেখযোগ্য। ষাটের দশকের কবিতায় ও সাহিত্যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে এসেছেন কেউ কেউ। স্থানীয়দের সংগঠিত করার লক্ষ্যে গঠিত হয় কুঁড়ি সাহিত্য গোষ্ঠী ও অনিত্য সংসদ। কুঁড়ি সাহিত্য গোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন ফেনী কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক জোত্লাময় দেব। জোত্লাময় দেব ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। ফেনীর সাহিত্য ও লেখালেখির জগতে নতুন প্রজন্মকে সংগঠিত করতে তিনি অভিভাবক হিসাবে কাজ করেছেন। এ সময় কুঁড়ি সাহিত্য গোষ্ঠীর সহযোগী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে অনিত্য সংসদ। জাহিদুল হক এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ফেনীতে সাহিত্য ও সংস্কৃতির আন্দোলনকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে এ সংগঠনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। অনিত্য সংসদকে নিয়ে যারা এ আন্দোলনে এগিয়েছিলেন তারা হচ্ছেন রফিক রহমান ভূঁইয়া, মির্জা আবদুল হাই, আবুল কাশেম প্রমুখ তরুণ লেখক।ষাট দশকের শেষ প্রান্তে এসে সত্তরের প্রথমার্ধে ফেনীর সংস্কৃতির ভুবনে সংগঠিত হয় 'তিথী'। তিথি মূলতঃ দাঁড় করিয়েছিলেন রফিক রহমান ভূঁইয়া ও মির্জা আবদুল হাই সহ আরও কয়েকজন কবি ও লেখক। 'তিথী' ছিল পুরোপুরি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা। তিথি'র সম্পাদনার দায়িত্বেও ছিলেন রফিক রহমান ভূঁইয়া। জন্মসূত্রে ফেনীর অধিবাসী নন কিন্তু লেখালেখির সাথে সংশ্লিষ্ট দুই জন ব্যক্তিত্ব তিথি'র সাথে জড়িত ছিলেন। এদের একজন ফেনীর তত্কালীন ম্যাজিস্ট্রেট আলী আহমদ। অন্যজন ফেনী পিটিআই'র তদানীন্তন সুপারিনটেনডেন্ট আহসানউল্লা চৌধুরী। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, খাজা আহমদ ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। কিন্তু সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতির প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। চল্লিশ দশকে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক 'সংগ্রাম' পত্রিকা প্রকাশিত হলে তত্কালীন প্রজন্মের জন্য তা সুখবর হিসাবে আবির্ভূত হয়। সংগ্রাম পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় নবীন লেখকদের গল্প, কবিতা ও সাহিত্য বিষয়ক লেখা ছাপা হতে থাকে। সাহিত্য অংশটি সম্পাদনা করতেন রফিক রহমান ভূঁইয়া। ষাটের শেষে সত্তর যেখানে শুরু সে সময় ফেনী কলেজের বাংলার প্রভাষক হারুন উর রশিদ চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনার সময় সম্পাদনা করতেন 'যাত্রিক'। যাত্রিক একটি সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা। রফিক রহমান ভূঁইয়া একই কলেজে হারুন উর রশিদের সহপাঠী ছিলেন। তিনি সম্পাদনা করতেন 'দু''পাতা'। '৫০-৬০'র দশকের মাঝামাঝি সময় ফেনীর আরেকজন কৃতী লেখকের সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় ব্যাপক ভূমিকা ছিল। তিনি হচ্ছেন রশিদ আল ফারুকী। তিনি পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তার ছোট ভাই আকতারুন্নবীও লেখালেখিতে জড়িত ছিলেন। অনুবাদেই বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। অনেক খ্যাতিমান লেখকদের লেখা বই অন্য ভাষা থেকে (বিশেষ করে উর্দু থেকে) অনুবাদ করেছেন তিনি। স্কুল জীবনে বাদল নাগ কবিতা লিখতেন। একজন স্কুল ছাত্রের পক্ষে কবিতা লেখা অসম্ভব কিছু ছিলনা। কিন্তু বাদল নাগের লেখা জীবনধর্মী ও প্রেমের কবিতা ছিল হূদয়গ্রাহী। সত্তরের দশকে ফেনীতে বেশ কয়েকটি সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে এবং এগুলোর প্রকাশনাও প্রায় দীর্ঘকাল অব্যাহত ছিল। এর মধ্যে 'সোনার হরিণ গোষ্ঠী' শহরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। জাফরুল্লাহ খাঁনের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'সোনার হরিণের' নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কবি মুহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী।
২০০০ সালের পর থেকে সাহিত্য চর্চায় ব্যাপক উজ্জ্বলতা ছড়ায় কবি আবু হেনা আবদুল আউয়াল সম্পাদিত অনিয়মিত প্রকাশনা 'নোফেল'। ২০০২ সালে নোফেলের যাত্রা শুরু হয়। সবদিক দিয়ে নোফেল একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য সাময়িকী হিসাবে পাঠকদের মাঝে স্থান করে নিয়েছে। আবু হেনা আবদুল আউয়াল জাতীয় পর্যায়ের আশির দশকের কবি। কিন্তু আঞ্চলিক সাহিত্যেও তার সমান আগ্রহ। 'সরাসরি' একটি মাসিক ম্যাগাজিন। এর সম্পাদনায় রয়েছে্ন মুহাম্মদ আবু তাহের ভূঁইয়া। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত এই মাসিকে ফেনীর প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিশ্রুতিশীল কবি ও সাহিত্যিকদের প্রতিভা এবং বন্যাঢ্য জীবনের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। নতুন প্রজন্ম এতে সে সব কৃর্তীমানদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে, যা তাদের সাহিত্যচর্চায় অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। এ সময় কিছু তরুণ কবি এগিয়ে আসে ম্যাগাজিন ও ট্যাবলয়েড সাইজের কিছু প্রকাশনা নিয়ে।
পঞ্চাশ দশক থেকে এ যাবত্ কাল ফেনীর সাহিত্যসাংস্কৃতির সেকাল একালের মধ্যবর্তী জায়গায় সাহিত্যচর্চার ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। তবে এখনো যা ঘটছে বিচ্ছিন্নভাবে ফেনীর সাহিত্যচর্চাটি পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান। যাকে বলা যায় 'জেনারেশন গ্যাপ'। বৃহত্তর স্বার্থে এর অবসান হওয়া উচিত।