ড. সাব্বীর আহমেদ
বিশ্বজিত্ দাস। পেশায় একজন দর্জি। পত্রিকার ছবিতে দেখলাম একটি নিষ্পাপ তরতাজা যুবককে আদিম পাশবিকতার সর্বোচ্চ হিংস্রতা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রলীগের ক্যাডাররা কেউবা চাপাতি দিয়ে কুপাচ্ছেন, কেউবা রড দিয়ে পেটাচ্ছেন। কেউ বাঁচাতে আসেনি বিশ্বজিেক। জনারণ্যেই তাকে মারা হলো। পুলিশও ছিল নিষ্ক্রিয় দর্শক। রাজনৈতিক সহিংসতার এই পাশবিক চেহারা নতুন নয়, আগেও হয়েছে।
১০ ডিসেম্বর ১৮ দল আহূত অবরোধ বানচাল করতে নামে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কিছু ক্যাডার। যারা পুরোনো ঢাকা এলাকায় অবরোধ বানচালে রাস্তায় তত্পর ছিল। ঠিক ঐ সময়ই নিরীহ পথচারী বিশ্বজিত্ দাস পড়ে গেল কতগুলো নরপশুর কোপানলে। বিরোধী দলের সদস্য সন্দেহে তাকে আক্রমণ করলো তারা। বারবার সে নিজেকে অরাজনৈতিক, এমনকি হিন্দু হিসেবে পরিচয় দিলেও ক্যাডারদের উন্মত্ততার কাছে তার সেই বাঁচার আর্তি কোন আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম হলো না। কেন এই পাশবিকতা? বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে এই পাশবিক আচরণের প্রকাশ কেন? বিশ্বজিত্ দাসের করুণ মৃত্যুর বিশ্লেষণ থেকেই আমাদের এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।
আমার মতে, বিগত দিনের রাজনৈতিক সহিংসতা এবং বিশ্বজিত্ দাসের মৃত্যুর সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রের একটি সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। একটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ন্যস্ত। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে শাসকশ্রেণীর অনাগ্রহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ প্রবণতাকে অধিকতর শক্তিশালী করেছে। এই রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ এখনও যথার্থ অর্থে স্বাধীন নয়। আইন বিভাগও প্রকৃত অর্থে কার্যকর নয়। দেশের নির্বাচন পদ্ধতি এক ব্যক্তি এক ভোট হওয়ায় যে দলই রাষ্ট্র ক্ষমতার যায় সেই দলই ক্ষমতাকে নিজের মতো করে কুক্ষিগত করতে চায়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলেও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি শক্তিশালী না হওয়ায় যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলই একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করে। আইনের শাসন কেবলমাত্র বিরোধীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, নিজেদের অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া হয়। বিরোধিতাকে সহ্য করা হয় না। মানবাধিকার নিয়েও ক্ষমতাসীনদের মাথা ব্যথা নেই। এই অসহিষ্ণুতাই ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থকদের সহিংস আচরণে উত্সাহিত করে। বিশ্বজিত্ দাসের প্রাণহানি কী এই সহিংসতার ফল নয়?
আমাদের সংবিধানের ৩২ ধারা অনুসারে প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল, তার ছাত্র সংগঠনকে বিরোধী দলের অবরোধ ঠেকাতে রাস্তায় নামিয়ে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের আইন নিজের হাতে তুলে নিতে কী উত্সাহ যোগায়নি? তাই বিশ্বজিত্ দাস হত্যার দায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের এড়িয়ে যাবার কোন উপায় আছে কী?
বিশ্বজিত্ দাসকে হত্যার সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং পরবর্তীতে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অনুপ্রবেশকারী ছাত্রদল বা শিবির হিসেবে আখ্যায়িত করে ঐ ক্যাডারদের বাঁচানোর প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে পুলিশের রাজনৈতিক ভূমিকারই সমার্থক। পুলিশ সবসময় ক্ষমতাসীন দলের অন্যায়ের পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেছে। আবার দুই-একজন মন্ত্রী যখন বলেন, এই হত্যা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী শিবিরের কাজ। একজন সচেতন বিবেচক মানুষের কাছে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? ক্ষমতাসীন দলের এ ধরনের হরতাল-অবরোধ ঠেকানোর কৌশল কী অগণতান্ত্রিক আচরণ নয়? বিশ্বজিতের মৃত্যু থেকে এটি ধারণা করা কি ভুল হবে যে, ক্ষমতাসীন দল বলতে চাইছে আমরা যা বলি তাই মেনে নাও। নতুবা বিশ্বজিত্ দাসের মতোই অবস্থা হবে।
বিশ্বজিত্ দাসের মৃত্যু আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরের দুর্বলতাকেও স্পষ্ট করে দেয়। রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় দলগুলোর নেতৃত্বের মধ্যে অসহিষ্ণু আচরণের খুব একটা পরিবর্তন এখনও লক্ষ্য করা যায় না। লক্ষ্য করুন, সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, বিশ্বজিতের হত্যাকারী সত্যিকারের ছাত্রলীগ নয়, এরা ছাত্রলীগ নামধারী শিবির অথবা ছাত্রদলের সদস্য, এই কথা দ্বারা আমাদের মন্ত্রীরা কী বুঝাতে চাইছেন? আমরা যা বুঝতে পারি ছাত্রলীগে শিবির অথবা ছাত্রদল ঢুকে গেছে। কীভাবে তারা ঢুকলো? কে তাদের ঢুকালো? শিবির বা ছাত্রদল থেকে অনুপ্রবেশকারীরা কী ছাত্রলীগের আদর্শের প্রভাবে মুগ্ধ হয়ে ছাত্রলীগে এসেছে? এটি বুঝতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ক্ষমতাসীন দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে এই অনুপ্রবেশকারীরা সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে চায়। নিজদের নিরাপদ রেখে আখের গোছাতে চায়। এরা ভালো করেই জানে, আমাদের রাজনীতিতে প্রাধান্যশীল প্যাট্রন্ড ক্লায়েন্ট সম্পর্কের চরিত্র। তাই তারা ক্ষমতাসীন দল বা দলের নেতাদের খুশি করতে চায়। তারা তাদের বিশ্বস্ত ক্লায়েন্ট বা তাঁবেদার হতে চায়। যত বেশি হিংস্রতা দেখানো যায়, ততই উপরে ওঠা সম্ভব। তাই ছাত্রলীগের যে কোন অপকর্মের দায় অনুপ্রবেশকারী শিবির বা ছাত্রদলের সদস্যদের উপর চাপানো হয়। এ দ্বারা আসলে ছাত্রলীগের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার অভাবকেই চিহ্নিত করে, স্পষ্ট করে দেয় দলের ভিতর আদর্শহীনতার সংকটকে। যাদের তুলে ছাত্রলীগের সদস্যভুক্তি করা হচ্ছে, তারা আদর্শের কারণে দলে আসছে না, বরং ছাত্রলীগকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করার জন্যই আসছে।
পাশবিক বর্বরতায় বিশ্বজিতের মৃত্যু সাধারণ মানুষের মনে রাজনীতি সম্পর্কে ভয় সৃষ্টি করে। তাই মানুষ পথ চলতে ভয় পাবে, কথা বলতে ভয় পাবে। ভয় পেলে আর প্রতিবাদ হবে না। আর প্রতিবাদ না হলে গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে যাবে। এটি শুভ লক্ষণ যে, পুরোনো ঢাকার মানুষ সংঘবদ্ধভাবে এই হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ থাকাটা খুবই জরুরি। কারণ, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল যখন পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সন্ত্রাসের মদদ দেয়, তখন সেখানে জনগণের সংগঠিত প্রতিরোধ ছাড়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আর কোন বিকল্প পথ নেই। বিশ্বজিত্ দাসকে যারা পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে আমরা তার বিচার চাই। আর যদি তাদের বিচার না হয় আসুন তাদের আমরা সমাজচ্যুত করি, ঘৃণা করি। সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে এই ভূমিকা আমাদের সকলেরই পালন করা উচিত। বিশ্বজিতের আত্মা স্বর্গবাসী হোক এই আমাদের প্রার্থনা। আর সকলের সাথে মিলে আমারও করজোড়ে মিনতি, তুমি আমাদের অক্ষমতাকে ক্ষমা কর বিশ্বজিত্।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়