মো. তারেক হোসেন
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন দেশে তারা যে সুশাসন আশা করেছিল, তা কিন্তু বিভিন্ন কারণে '৭২ থেকে '৭৫ পর্যন্ত সেই সময়কার শাসক গোষ্ঠী তাদের কাঙ্ক্ষিত সুশাসন দিতে পারেনি। যদিও জিয়ার আমলে কিছুটা সুশাসনের স্বাদ দেশবাসী পেতে শুরু করেছিল (যদিও তার ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলে) কিন্তু এই সুশাসনের হাতছানি স্তব্ধ হয়ে যায় জেনারেল এরশাদ কর্তৃক বিচারপতি সাত্তার এর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে। তখন থেকে যে সুশাসন এদেশ থেকে উড়াল দিয়েছিল এখনো আর ফিরে আসেনি। এখন জেঁকে বসেছে দুর্নীতি, লুটপাট, কালোবাজারি, সিন্ডিকেট, সন্ত্রাস, হত্যা, গুমসহ প্রত্যহ মানবাধিকারের লঙ্ঘন আর রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আমাদের নিত্যসঙ্গী। জন্মের পর থেকে বুঝে উঠার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো দেখতে দেখতে এমন মনে হয় যে, রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে বরং ব্যতিক্রম মনে হয়। ২০০৭ সালের আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কারণে ২২ জানুয়ারি নির্বাচনটি না হওয়ার ফলে যে অস্বাভাবিক সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল, তাদের কার্যক্রম আর তাদের পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের কিছু কার্যক্রমে অতিষ্ঠ হওয়া মানুষ বিশেষ করে বলবো তরুণদের সাথে যে উত্কণ্ঠা, ক্ষোভ আর হতাশা চেপে বসেছিল ঠিক তখনি ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে নিয়ে আসে একগুচ্ছ মহাপ্রতিশ্রুতি। তারা বলছে, দেশের সব সমস্যার সমাধান করে দিবে। রাজনৈতিক সংস্কারের উন্নয়ন ঘটাবে, তারা তরুণদের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে বলেছিল ঘরে ঘরে চাকরি দিবে, বিনামূল্যে সার দিবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাবে; তাদের দিন বদলের সনদে বলেছিল দেশে সত্যি করে সুশাসন এনে দেবে ইত্যাদি হাজারো প্রতিশ্রুতি। তরুণরাও আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে যে, এবার কিছু একটা হবে এই দেশটার। কিন্তু সরকারের প্রায় চার বছর মেয়াদের পর কি দেখছি আমরা তরুণরা তার একটু মূল্যায়ন তুলে ধরছি—
(১) সরকারের প্রতিশ্রুত রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতির পরিবর্তে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অবনতি হয়েছে। সরকার বিরোধী দলগুলোকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বিরোধী নেত্রীকে বাড়িছাড়া করে রাজনীতিতে একটি ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। সরকার সবচেয়ে যে পেরেকটি ঢুকিয়েছে সেটা হলো কোন জনমত যাচাই না করে দেশের সুশীল সমাজ বিশিষ্ট আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে আদালতের রায়ের দোহাই তুলে তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি তুলে দেয়া। মূলত এজন্য বর্তমানে রাজনৈতিক সংকট আর অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সরকার নিজেদের নামে মামলা তুলে নিয়ে বিরোধী দলগুলোর নেতাদের অযথা হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে রাজনীতিতে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে। এসব দেখে মনে হয়, সরকারি দলের আগামী নির্বাচনে পরাজয়ের ভয় ঢুকে গেছে।
(২) সরকার বলেছিল ঘরে ঘরে চাকরি দিবে। কিন্তু তরুণরা যারা লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করব এই আশায় আছি। সেই আমরা এখন ভরসা পাচ্ছি না, এরমধ্যে বিসিএস এর মতো একটি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি আমাদের জন্য এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি দলের নেতাদের তদবির আর বিপুল টাকাকড়ি ছাড়া চাকরি পাওয়া যায় না।
(৩) আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, একপক্ষ অন্যপক্ষের ওপর ধারালো আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। এক সহপাঠী অন্য সহপাঠীর জীবন কেড়ে নিচ্ছে রাজনীতির নামে। ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও করে তছনছ করে দিচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার উপকরণ আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
(৪) আজ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই , গুম হয়ে যাচ্ছে ইলিয়াস আলীর মতো অসংখ্য সন্তানের বাবা, অসংখ্য মায়ের সন্তান, ধনী-গরিব কারো নিরাপত্তা নেই। শিশু পরাগের বাবার সম্পত্তি থাকার জন্য তাকেও করা হয়েছে অপহরণ। এখন লাশ পাওয়া যায় ব্রিজের নিচে, ড্রেনে, নর্দমায়, আবার কেউ কেউ লাশ খুঁজে পায় না।
(৫) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কেমন হয়েছে তা রাস্তাঘাটে নামলেই দেখা যায়। এই সরকারের প্রতিশ্রুত পদ্মা সেতু হলো না, এলিভেটেড ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম দুই লেনের রাস্তা কিছুইতো এখনো হলো না। দুর্নীতি সর্বত্র ছেয়ে গেছে, দুর্নীতিই এখন নীতি, হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ার বাজার থেকে লুটপাট করা হয়েছে হাজার হাজার টাকা। কই? কোথাও তো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নেই, আইনের শাসন নেই, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নেই, মানুষের কোন নিরাপত্তা নেই, চারদিকে শুধু ভয়-আতংক আর উত্কণ্ঠা।
এদেশের শিক্ষিত তরুণরা এখন আর এদেশে থাকতে চাইছে না, যাদের একটু ক্ষমতা আছে তারাই পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। তার মানে এই নয় যে, এদেশটার প্রতি তাদের কোন ভালোবাসা নেই। তারা দেশকে ভালোবাসে বলেই এসব দুঃশাসন সহ্য হয় না। তরুণরা এদেশের সম্পদ, বিগত নির্বাচনে তরুণরাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল; কিন্তু তরুণদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি, তরুণদের জন্য কর্ম-সংস্থানের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি, কাজেই তরুণরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু যেসব তরুণ বিদেশে যেতে পারবে না তাদের কি হবে? আমাদের শাসকগোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল যারা ক্ষমতায় আছেন বা যাওয়ার চিন্তা করছেন তারা কি তরুণদের জন্যে কোনো উদ্যোগ নিবেন? দেশে সুশাসন ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন? যাতে তরুণরা বিদেশে যেতে নিরুত্সাহিত হয় বরং দেশে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
লেখক :সমাজকর্ম বিভাগ,
শাবিপ্রবি, সিলেট