
বাংলাদেশের মাটি মানুষ জল হাওয়ার সঙ্গে তার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। নড়াইলের কালিয়ায় তার পিতৃপুরুষের ভিটা বলে শুধু নয়, রবীন্দ শংকর চৌধুরী থেকে বিশ্ববিশ্রুত সেতার বাদক রবি শংকর হয়ে ওঠার পেছনেও রয়েছে এই বাংলার নিবিড় যোগাযোগ। নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বড় কালিয়া গ্রামের শ্যাম শংকর চৌধুরী তার জন্মদাতা পিতা আর যে মানুষটি তাকে হাতে ধরে বিশ্বসেরা সেতার বাদকের খ্যাতি অর্জনের সিঁড়িতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের অন্যতম প্রাণপুরুষ ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ। আলাউদ্দীন খাঁ না থাকলে যে পণ্ডিত রবি শংকরকেও পাওয়া যেত না, সে কথা রবি শংকর নিজেই বারবার উল্লেখ করেছেন গভীর শ্রদ্ধায়। আলাউদ্দীন খাঁ মানুষ হিসাবে যেমন কোমল হূদয়ের ছিলেন, সুরসাধক হিসাবে ছিলেন তেমনি কঠোর। সুর সাধনায় বিন্দুমাত্র অবহেলা সহ্য করতেন না এই সঙ্গীত গুরু। গুরুর আদেশ ঠিকমত পালন না করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিভৃত পল্লীতে আলাউদ্দীন খাঁয়ের বাড়ির আঙিনায় রবি শংকরকে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে প্রখর রোদের মধ্যে। রবি শংকরের মতো আরেক বিশ্ব বিখ্যাত বাদক, অনন্য সরদীয়া ওস্তাদ আলী আকবর খাঁকেও মাথা পেতে নিতে হয়েছে একই সাজা।
নবাব আমলে জমিদার হিসাবে হর চৌধুরী খেতাব লাভ করেন রবি শংকরের পূর্ব পুরুষ; কিন্তু রবি শংকরের বাবা শ্যাম শংকর 'হর' কথাটি বাদ দিয়ে শুধু চৌধুরী ব্যবহার করতেন নিজের নামের সঙ্গে। শ্যাম শংকর ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে তিনি বিলেতে চলে যান উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য। বিলেত যাওয়ার আগে তিনি চাকরি সূত্রে বারানসীতে থাকতেন। সেখানেই ১৯২০ সালে জন্ম হয় রবি শংকরের। রবি শংকরের বড় ভাই কিংবন্তীতুল্য নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের জন্মও
এখানে। শ্যাম শংকর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন এবং তিনি লন্ডনেই ব্যারিস্টার হিসাবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। বাবা লন্ডনে যখন আইন ব্যবসা করতেন উদয় শংকর ও রবি শংকরসহ চার ভাই বারানসীতেই থাকতেন মা হেমাঙ্গিনী দেবীর সঙ্গে। শৈশবে রবি শংকরের নাম ছিল রবীন্দ শংকর চৌধুরী। পরে তিনি তার নাম সংক্ষিপ্ত করে হয়ে যান রবি শংকর। তার বয়স আট বছর হওয়ার পরই তিনি প্রথম তার বাবা শ্যাম শংকরকে দেখার সুযোগ পান। দশ বছর বয়সে বড় ভাই উদয় শংকরের নৃত্য দলের সদস্য হিসাবে রবি শংকর চলে যান প্যারিস। এই সময় তিনি ফ্রেন্স শেখেন এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তবে দেশে ফেরার পর ১৯৩৪ সালে কলকাতায় এক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর সরোদ শুনে কিশোর রবির মনে এক অজানা শিহরণ জাগে। তার মনে হয়, এমন গুণী সুর সাধকের কাছে দীক্ষা নিতে না পারলে তার জীবনটাই বৃথা। এর পরের বছর ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ শিস্যত্বে বরণ করেন রবি শংকরকে।
রবি শংকরের জীবনে এর পরের ইতিহাস শুধু এগিয়ে চলার। বিশ্বে এমন একজন সঙ্গীত প্রেমীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি রবি শংকরকে জানেন না। গত মঙ্গলবার সমস্ত বাঙালিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চিরতরে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অস্ত গেল সঙ্গীত আকাশের রবি। তার শেষ ইচ্ছা ছিল, পিতৃভূমিতে আর একবার আসার। শরীর সে সুযোগ দেয়নি তাকে। নড়াইলের কালিয়াবাসী তাদের এই প্রিয় মানুষটির চির বিদায় উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আগামী কাল শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে এসব কর্মসূচি। রবি শংকরের পিতৃপুরুষের বাড়িটি রয়ে গেছে এখনো। কালিয়ার উপজেলা ডাকবাংলো হিসাবে ব্যবহূত হয় এই ভবন। শুধু একজন সুর সাধক হিসাবে নয়, বিশ্ববিখ্যাত মানুষ হিসাবে নয়, এদেশের মানুষ তাকে চিরকাল স্মরণ করবে বাঙালির চরম দুর্দিনের সাথী হিসাবে, স্বজন হিসাবে, সমব্যথী হিসাবে।