আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে, আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্বক্ষণে— নির্মমভাবে হত্যা করা হইয়াছিল শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিত্সক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাসহ জাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেধাবী সন্তানকে। ইহা সর্বজনবিদিত যে, স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করিয়াছিল। মানবেতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য ও নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞের সূচনা হইয়াছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ, আর তাহা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল ১৪ ডিসেম্বর। 'বাংলাপিডিয়া'য় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, একাত্তরের ২৫ মার্চ হইতে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিত্সক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিককে হত্যা করা হইয়াছিল। ঘাতকদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করিবার জন্য এই তালিকাটিই যথেষ্ট বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে। নিরীহ নিরস্ত্র এই মানুষগুলি কাহারো বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন নাই। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথেও তাহাদের কোনো প্রকার সংশ্রব ছিল না। তাহা সত্ত্বেও নজিরবিহীন বর্বরতার সাথে তাহাদের হত্যা করা হইয়াছে। কারণ বংশানুক্রমিকভাবে দরিদ্র, নিরক্ষর, পশ্চাত্পদ ও পরাধীন এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের চেতনা জাগ্রত করিবার পিছনে মূলত তাহারাই বাতিঘর হিসাবে কাজ করিয়াছেন। তাহাদিগকে অনুপ্রাণিত করিয়াছেন ঐক্য, সংহতি ও মুক্তির মন্ত্রে। শত্রুপক্ষ ইহা ভালো করিয়াই জানিত। জানিত বলিয়াই পাকিস্তানের সূচনালগ্ন হইতেই দেশটির স্বৈরশাসক গোষ্ঠী তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত, সচেতন ও অগ্রসর এই মানুষগুলির প্রতি চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করিয়া আসিয়াছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল দীর্ঘদিনের লালিত সেই ঘৃণা-বিদ্বেষেরই বহিঃপ্রকাশ।
এই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, স্বাধীনতার ৪১ বত্সর পরে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি আমাদের জন্য কতোখানি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়? যুগে যুগে বিশ্বের বরেণ্য মনীষীরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যেই কথাটি বলিয়া গিয়াছেন তাহা হইল— দেশের জন্য যাহারা জীবন উত্সর্গ করেন তাহারাই হইলেন প্রকৃত বীর। আর বীরের আত্মদান কখনই বৃথা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে একাত্ম হইয়া বলা যায়, 'বীরের রক্তস্রোত' আর 'মায়ের অশ্রুধারা' কখনই বিফলে যায় নাই। যতো বিলম্বেই হউক 'রাত্রির তপস্যা' বরাবরই উজ্জ্বল 'দিন' আনিয়া দিয়াছে। ইতিহাসের বিচারেও তাই দেশের জন্য আত্মোত্সর্গকারী প্রকৃত বীরেরা যেমন যথোচিত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন, তেমনি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হইয়াছেন তাহাদের বিরুদ্ধাচরণকারীরা। মনে রাখিতে হইবে যে, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সেইদিন দেশের জন্যই জীবন উত্সর্গ করিয়াছিলেন। পরাধীনতার সেই অন্ধকার দিনগুলিতে তাহারা তাহাদের বর্তমানকে উত্সর্গ করিয়াছিলেন বলিয়াই আমরা স্বাধীনতা পাইয়াছি। আমাদের যতো দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অভিযোগই থাকুক না কেন— আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে মাথা উঁচু করিয়া মুক্ত আলো-হাওয়ায় বিচরণ করিতে পারিতেছি। ইহার চাইতে বড়ো প্রাপ্তি আর কী হইতে পারে! অতএব, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশই শুধু নহে, অনুপ্রেরণার অবিনাশী উত্সও বটে। সঙ্গত কারণেই জাতীয় জীবনে তাহাদের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা কখনই ফুরাইবার নহে। বাংলাদেশ যতদিন থাকিবে, ততদিন তাহাদের নামও অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হইবে। স্বদেশের স্বাধীনতা ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে যাহারা আত্মোত্সর্গ করিয়াছেন কথাটি তাহাদের সকলের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য।