জাগিয়া ঘুমায় যাহারা, কে জাগাইবে তাহাদের! বিপুল গর্জনে আকাশ বিদীর্ণ করিয়া মিছে ঘুম ভাঙ্গিয়া দিতে পারে যে বিপুল জনতা, তাহারা কোথায়! 'ইহারা প্রশ্ন করে নাকো:... , ইহাদের দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই-চোখে ঘুম আসে।'—এই সখেদ উচ্চারণ কবি জীবনানন্দ দাশের। যে প্রেক্ষাপটেই কবি এই আক্ষেপ করিয়া থাকুন না কেন, আজকের এইদিনে আমাদের এই ষোল কোটি মানুষের দেশে আমরাও যেন হইয়া গিয়াছি তাহাদের মত, যাহাদের মনে প্রশ্ন নাই, দ্বিধা নাই, ব্যথা নাই। যেনবা পাথরের মত অচেতন নির্বিকার।
জীবিকার অন্বেষণে গ্রাম ছাড়িয়া স্বপ্নের শহরে আসিয়াছিল যে তরুণ, 'শুধু প্রাণ ধারণের, শুধু দিনযাপনের গ্লানি' মোচন ছাড়া যাহার আর কোনো আরাধ্য ছিল না, তাহার জীবন কাড়িয়া নিয়াছে নৃশংস ঘাতকেরা। প্রকাশ্য দিবালোকে, লোকচক্ষুর সম্মুখে পিটাইয়া, চাপাতি দিয়া কোপাইয়া ক্ষত-বিক্ষত করিয়া হত্যা করা হইয়াছে তাহাকে। ফিনকি দিয়া রক্ত বাহির হইয়াছে, তাহার শোণিত ধারায় ভিজিয়াছে শার্ট। সেই অসহায় যুবকের আর্তনাদ, প্রাণের আকুতি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইয়াছে বাতাসে। কিন্তু হূদয় টলে নাই কাহারও। না খুনিদের, না অদূরে দণ্ডায়মান আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীদের। নির্বিকার ছিলেন তাহারাও, যাহারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হইবার সেই পৈশাচিক দৃশ্য ধারণ করিয়াছে সংবাদপত্রের ক্যামেরা। সেই চলচ্ছবি ধরা পড়িয়াছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরাতেও। সংবাদপত্রে সেইসব স্থিরচিত্র ছাপা হইয়াছে, টেলিভিশনে প্রদর্শিত হইয়াছে ভিডিও ফুটেজ। তবুও খুনিদের চিনিতে দ্বিধাগ্রস্ত আইন প্রয়োগকারীরা। খুনিরা ধরা পড়িয়াছে, ধরা পড়ে নাই—এই নিয়া ধূম্রজাল। পিশাচ খুনিদের রাজনৈতিক দলীয় পরিচয় লইয়া তর্ক-বিতর্ক, তাহাদের কুষ্টি বিচারে ব্যস্ত জ্ঞানী বিশ্লেষকগণ। টেলিভিশনের পর্দায় ঝড় তুলিয়া যাইতেছেন সুশীলগণ। দেশের ভবিষ্যত্ গণনায় রত তাহারা। এই তো চলিয়া আসিয়াছে যুগ যুগ ধরিয়া। নূর হোসেন বুকে ও পীঠে গণতন্ত্র মুক্তি পাক লিখিয়া জীবন দেন ২২ বছর আগে। তারপরে আরও বহু মানুষের রক্ত ঝরিয়াছে। ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিবর্তন আসে, কিন্তু মৃত্যু ও বঞ্চনার দৃশ্যপট বদলায় না। এ বলে তুই চোর, সে বলে তুই মহাচোর। চিন্তাশীল বলেন, মন্দ উভয়ই। আর নিরাসক্ত সাধারণ মানুষ এই কূলে একবার, ওই কূলে আরেকবার। পালাবদলের এই আমাদের বাস্তবতা।
পক্ষে-বিপক্ষের মতভিন্নতা অনেক আগেই পরিগ্রহ করিয়াছে জান্তব হিংস্রতার রূপ। মানুষ মরিতেছে। অপঘাত মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইতেছে। জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন চলিতেছে বিরামহীন। শেয়ারবাজার নিঃশেষিত। ব্যাংক ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম। শান্তির ললিত বাণী শোনাইছে ব্যর্থ পরিহাস। তবু আছে, আছে শুধু সেমিনার-সিম্পোজিয়াম। গোলটেবিলে মুখর সুশীলগণ। অন্যদিকে সাফল্যের কথা বয়ান করিয়া মহাকাব্য রচনা করিয়া চলিয়াছেন নির্বিকার সুখে থাকা মহান যারা। ততোধিক নির্লিপ্ত ষোল কোটি মানুষ!
কিন্তু কেন! কে তাহাদের বিবেককে ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়াছে! ইহা কোন সংস্কার! কোন সে অভিভাবক যে তাহাদের বলিয়াছে, ঘুমাও মানুষ, জাগিও না। প্রশ্ন করো না। প্রতিবাদ করো না। অষ্টাদশ শতকের জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট যথার্থই বলেন, যুক্তি প্রয়োগের দৃঢ়তা ও সাহসের অভাব যখন দেখা দেয়, তখন অন্যের নির্দেশ ছাড়া মানুষের পক্ষে চলা অসম্ভব হইয়া পড়ে। অতএব, নিজের যুক্তি প্রয়োগের জন্য সাহস অবলম্বন করো। ইহাতেই 'মুক্তি'। মনে রাখা দরকার, যে জাতি যেরকম নেতৃত্ব পাইবার যোগ্য, সেরকমই পাইয়া থাকে।