১৯৭১। ত্রিপুরার আগরতলার নোয়াবাদী শরণার্থী শিবির থেকে একটি গণসঙ্গীতের দল বের হলো। পঞ্চাশোর্ধ সৌম্যকান্তির একজন মানুষ কাঁধে হারমোনিয়াম বেঁধে উদাত্ত কণ্ঠে গণসঙ্গীত গাইছেন, তাঁকে অনুসরণ করছেন দশ-বারোজন নবীন-নবীনা। একের পর এক গান গেয়ে অগ্রসর হচ্ছে এ দল। দেশের গান, দুর্দিনে ধৈর্য ও মনোবল অটুট রাখার গান; প্রবল প্রতিরোধ ও সংগ্রামের গান। তারা গান গেয়ে চলেছেন শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে, পথিমধ্যে কোনো জনসমাবেশে। হারমোনিয়াম কাঁধে সেই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি কুমিল্লা শহরের গণমানুষের শিল্পী ওস্তাদ কুলেন্দু দাস। একাত্তরের মে মাস থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত জাগরণের এই প্রয়াস তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন।
কুমিল্লা জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে শচীন দেববর্মণ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, ফজলে নিজামী, সুখেন্দু চক্রবর্তী যে মাত্রা সৃষ্টি করেছিলেন, সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পী কুলেন্দু দাসের (১৯২০-১৯৮৫) নাম একই সূত্রে গাঁথা। সঙ্গীতশিক্ষার হাতেখড়ি তাঁর জ্যেষ্ঠ বোন শিল্পী শৈল দেবীর কাছে। তালিম গ্রহণ কবি নজরুলের কাছে। তাঁর নামটিও নজরুলেরই দেওয়া। খেয়াল, ঠুংরী, রাগপ্রধান, টপ্পা ও গণসঙ্গীতে তিনি অর্জন করেছিলেন বিশেষ দক্ষতা। শ্যাম ভট্টাচার্যের নিকট নৃত্যশিক্ষা লাভকারী এই কৃতী শিল্পীর কম্পোজকৃত নৃত্যের মধ্যে রয়েছে—'সাপুড়ে', 'শিকারী', 'জিপসি', 'রানার', 'অবাক পৃথিবী', 'কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা শোন', 'কারার ঐ লৌহকপাট'। রচনা, সুরারোপ ও পরিচালিত নৃত্যনাট্য 'ঝরাফুল', 'নবান্ন', 'নিদয়া গোমতী'। 'ফসলের ডাক', 'তাসের দেশ', 'ভাঙ্গাগড়া নোয়াখালী', 'এক দশকের বাংলাদেশ' প্রভৃতি নৃত্যনাট্যে সঙ্গীত ও নৃত্য পরিচালনা করেন তিনি। চল্লিশের দশকে আকাশবাণী, পরে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন কুলেন্দু দাস। সম্পৃক্ত ছিলেন পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সমবায় আন্দোলনে। 'বাণীবিতান', 'সুরবিতান', 'কুমিল্লা সঙ্গীত বিদ্যালয়' ও 'নোয়াখালী সঙ্গীত বিদ্যালয়' স্থাপনের মাধ্যমে প্রসার ঘটান সঙ্গীতশিক্ষার।
ভাষাআন্দোলন, সাংস্কৃতিক সম্মেলন ও ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে দেশাত্মবোধক ও গণসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেন বিপুল গণজাগরণ। শহরের সংস্কৃতিচর্চায় তাঁর ছিল বিরাট ভূমিকা। একাত্তরের বৈরী পরিস্থিতিতে সপরিবারে চলে আসেন ত্রিপুরার আগরতলায়। আশ্রয় নেন আগরতলার সন্নিহিত পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু এই সংস্কৃতিগত দেশপ্রাণ মানুষটির পক্ষে মাতৃভূমির ঘোর দুর্দিনে হাত গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। কণ্ঠকে অস্ত্র করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক যুদ্ধে। শরণার্থী শিবিরে বসেই তবলাবাদক শেফাল রায়-সহযোগে গঠন করেন 'স্বাধীনতা সঙ্গীত দল'। সেই দলে আরও ছিলেন কুলেন্দু দাসের সন্তান কল্যাণ দাস, কণিকা দাস, বেবী দাস, কৃষ্ণ দাস; শেফাল রায় এবং তাঁর কন্যা দীপালি রায়; উমা, হেনা, শান্তি—আরও অনেকে। দল তো গঠন হলো, হারমোনিয়াম পাবেন কোথায়? শরণার্থী শিবিরে ওস্তাদ কুলেন্দু দাসের আগমনের কথা শুনে স্থানীয় পঞ্চায়েত-প্রধান তার মেয়েকে গান শেখাতে বলেন। সেখান থেকে সংগৃহীত হলো হারমোনিয়াম। শেফাল রায় কোত্থেকে জোগাড় করলেন তবলা। রেওয়াজও চলল পঞ্চায়েত-প্রধানের বাড়ি কিংবা শিবিরের অপেক্ষাকৃত কোলাহলমুক্ত পরিসরে। দলের জন্য পুরোনো গান নয়, সময়ের প্রয়োজনে নিজে গণসঙ্গীত লেখা শুরু করলেন। শরণার্থী শিবিরে বসে গান লিখেছেন, বেঁধেছেন সুর। সেই গান নিবেদন করেছেন জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমীপে। এভাবে পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবির, গোমতী যুবশিবির, দুর্গা চৌধুরীপাড়া যুবশিবির, ইছামতি যুবশিবির প্রভৃতি স্থানে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করার কাজে ব্রতী হন আন্তরিকভাবে। গণসঙ্গীত পরিবেশনের সময়ে যুবশিবিরের শত শত মুক্তিযোদ্ধা স্লোগান ধরত—'জয় বাংলা'! মনে হতো গানের বাণী আপ্লুত করছে প্রতিটি মুক্তিকামী তরুণের মন।
ওস্তাদ কুলেন্দু দাস-রচিত গানগুলোর মধ্যে ছিল—'চল ভাই সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাই', 'ভাগো ভাগো ভাগো—/ ইয়াহিয়া ভাগো, ভুট্টো ভাগো', 'ধর্ ধর্ ধর্ ভুট্টোরে ধর্', 'এই বার, তিন শয়তানে লেজ গুটাইয়া ভাগেরে', 'চাচায়, গদ্দি ছাইড়া ভাগেরে খেত কোনাইচ্যা পথে', 'চাচা কি ভাব গো নিরালে বসিয়া', 'এই মাটিতে সোনা ফলে, এই মাটিতে কি না ফলে', 'হায়রে নিদয়া ইয়াহিয়া', 'আমাদের বাংলা মা স্বাধীন হল রে' ইত্যাদি। আসর শুরু হতো 'আমার সোনার বাংলা' ও 'ধন্যধান্যে পুষ্পভরা' দিয়ে। তারপর একুশ ও স্বাধিকার আন্দোলনের গান। এরপরই মঞ্চ মুখর হয়ে উঠত অগ্নিঝরা সব গানে। গানের মাঝে মাঝে ছিল ধারাভাষ্য। তা-ও কুলেন্দু দাসেরই লেখা। দিনরাত শিবিরে-শিবিরে গান গেয়ে ফিরেছেন। শরণার্থীরা গান শুনে মনোবল ফিরে পেতেন।
কীর্তিমান এই শিল্পীর জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রণীত স্মারকগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধকালে রচিত গানগুলো সংকলিত হয়েছে। মলিন-পাণ্ডুর গানের সেই খাতাটি আজও আগলে রেখেছেন সেদিনের দলের যাত্রী ও কুলেন্দু দাসের মেজোপুত্র কল্যাণ দাস। গানগুলোর প্রতিটি অক্ষর রক্তঝরা দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য মানুষের আত্মদানের কথা, অশ্রু ও বিষাদের কথা। মুক্তিযুদ্ধে নানা জায়গায় নানা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মূল লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিকভাবে মানুষকে মুক্তিচেতনায় উজ্জীবিত করা। সেক্ষেত্রে 'স্বাধীনতা সঙ্গীত দল'-এর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ববহ। কিন্তু এমন একটি মহত্ প্রয়াসের কথা এতদিন ছিল একেবারেই অজানা। কত মানুষের কত রকম ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে সেদিন বিজয় অর্জিত হয়েছিল, সেকথা আমরা যেন ভুলে না যাই। তাই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি গণজাগরণের শিল্পী কুলেন্দু দাসের প্রতি, স্মরণ করি মহত্ সেই কাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মুক্তিকামী প্রাণকে। শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আজ দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠি—'জয় বাংলা'!
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. নাসিম বলেছেন, 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া সুখবর না হলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন করতে হচ্ছে'। আপনিও কি তাই মনে করেন?