সরকার পরিবর্তন হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যেন কোনভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সংসদে আইন পাস করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে একটি স্থায়ী এবং প্রশাসনিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দাবি জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সেই সঙ্গে তারা ব্যক্তির পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন হিসেবে জামায়াত, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আল শামসের বিচার দাবি করেছে কমিটি। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা জোরদার ও ট্রাইব্যুনালে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের দাবি জানান কমিটির নেতৃবৃন্দ।
গতকাল সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক চক্রান্ত প্রতিরোধে সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়' বিষয়ে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তারা এই দাবি জানিয়েছেন। এতে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
লিখিত বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে দেশ-বিদেশে বহুমাত্রিক তত্পরতা চালাচ্ছে। শত কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ভাড়া করেছে দলটি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে চলা এসব চক্রান্ত প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলে আসছি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা মানে কেবল বিচারক, আইনজীবী বা কয়েকজন কর্মকর্তার জন্য নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ। আমরা অনেক দিন ধরেই ট্রাইব্যুনাল ও ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্ট সবার সার্বিক নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে আসছি। নিরাপত্তা নজরদারির অপ্রতুলতার কথাও আমরা বলেছিলাম। গোয়েন্দা নজরদারির ব্যর্থতার কারণেই ট্রাইব্যুনালের বিচারকের কম্পিউটারে প্রতিপক্ষের তস্কর হ্যাকাররা অনুপ্রবেশ করেছে। সংশ্লিষ্টরা আগেই সতর্ক হলে তা বন্ধ করা যেত। তিনি বলেন, সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্র ও যোগাযোগের সব উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার আছে। এই নিরাপত্তা ভঙ্গকারীর জন্য ফৌজদারি আইনে শাস্তির বিধানও আছে। জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক একটি পত্রিকা স্কাইপে টেলিফোনের যে কথোপকথন প্রকাশ করেছে, সেটি তারা চুরির মাধ্যমে পেয়েছে। কাজেই নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও ফৌজদারি আইন লঙ্ঘন করে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ করে সংবাদপত্রের নীতিমালা, বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করেছে ওই পত্রিকাটি।'
শাহরিয়ার কবির বলেন, 'আমার দেশ' পত্রিকা লিখেছে, জিয়াউদ্দিন নির্মূল কমিটির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু জিয়াউদ্দিন বা রায়হান রশিদ কখনোই নির্মূল কমিটির সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না; বরং জিয়াউদ্দিন কোন এখতিয়ারে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে উপদেশ ও পরামর্শ দেন, আমরা সেটিই জানতে চাচ্ছি।'
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য সরকারের কাছে পাঁচ দফা দাবিও জানান শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হলে গোটা ট্রাইব্যুনাল এবং বিচারকসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কম্পিউটার হ্যাকিং ও টেলিফোনে আড়িপাতা, ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করে তথ্য চুরি, পাচার ও প্রকাশের জন্য আইনি বিধিনিষেধ আরও কঠোর করতে হবে। 'আমার দেশ'-এ প্রকাশিত স্কাইপে হ্যাকিং সম্পর্কে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করতে হবে। কারণ, আজ যারা ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের কম্পিউটারের তথ্য চুরি করেছে, কাল তারা জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কম্পিউটারেও হামলা চালাতে পারে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে আরও দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিচিতি-সম্পন্ন আইনজীবীদের সমন্বয়ে প্রসিকিউশনের জন্য একটি উপদেষ্টামণ্ডলী গঠনের দাবি জানান শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না করলে এবং দলটির অস্ত্র ও অর্থের উত্স বন্ধ করতে হবে।
নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি আমিরুল ইসলাম বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি আইনে কারও কম্পিউটার হ্যাক করলে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কেবল তা-ই নয়, চৌর্যবৃত্তি দ্বারা পাওয়া কোন তথ্য ব্যবহার করাও একই অপরাধ। কাজেই 'আমার দেশ' পত্রিকার সংশ্লিষ্টদের বিচার হওয়া উচিত।
কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, যে বিচারের অপেক্ষায় জাতি, সেই বিচার বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে যুদ্ধাপরাধীদের দুটি দল। জাতিকে আজ ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
শহীদ-জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ৪১ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রতিটি শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এই বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত-শিবির এই বিচার বানচালের চক্রান্ত করছে। কিন্তু এই বিচার না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
সাংবাদিক সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন, ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ, মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাসিনী, শিরীন বানু মিথিল প্রমুখ।