যুদ্ধের প্রস্তুতি: ১৯৭১'র ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের মানুষও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। মুক্তিযোদ্ধারা গড়ে তোলে দুর্বার প্রতিরোধ।
পাক বাহিনীর প্রবেশ: ১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনী ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে এসে মুহুর্মুহু শেল বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকে পড়ে। শুরু করে হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট। বাড়িঘরে লাগায় আগুন।
গণহত্যা: হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদররা সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালায় সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা গ্রামে। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী আশপাশের ৪/৫টি গ্রামের প্রায় ২ হাজার নিরীহ মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সেখানে ধরে নিয়ে এসে একত্রে গুলি করে হত্যা করে। পরে তাদের মাটি চাপা দেয়। এর মধ্যে অনেকে জীবিতও ছিল। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর জীবিত ৪জন মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা শুকানপুকুরী এলাকায় ভারতগামী কয়েক হাজার অবাঙালী ও অস্থানীয় লোককে আটক করে এবং স্বর্ণালংকার, টাকা-পয়সা লুটে নিয়ে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরে সমস্ত লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
ঠাকুরগাঁও চিনিকল এলাকায় চিনিকলের ২ কর্মচারী ও কৃষি ব্যাংকের একজন গার্ডকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। রামনাথ এলাকাতেও চালানো হয় গণহত্যা। এরপর পীরগঞ্জ থানার আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ সুজাউদ্দীন, বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, আতাউর রহমান, আব্দুল জব্বার ও মোজাফ্ফর আলীসহ ৭ জন রাজনৈতিক নেতাকে ধরে এনে পীরগঞ্জ-ঠাকুরগাঁও পাকা সড়কের তেঁতুলতলা এলাকার একটি আখক্ষেতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিভিন্ন সময়ে পীরগঞ্জ থানার প্রায় ৩ হাজার নিরীহ মানুষকে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ক্যাম্পে ধরে এনে তাদের হত্যার পর জগথা রাইস্ মিল ও সরকারি কলেজের পাশে মাটি চাপা দেয়া হয়। ভমরাদহ ইউনিয়নের দেশিয়া পাড়া নামক স্থানে স্থানীয় শতাধিক হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে হত্যা করে পাক হানাদাররা। পরে তাদের লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়। জেলার রানীশংকৈল থানা ক্যাম্পের পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ৫ হাজার লোককে ধরে এনে খুনিয়াদীঘি নামক পুকুরপাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যার পর তাদের লাশ পুকুরে ফেলে দেয়। গুলি করার আগে অনেককে পুকুরপাড়ের একটি শিমূল গাছের সাথে হাত-পায়ে পেরেক গেঁথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবর জানতে তাদের ওপর চালাতো অকথ্য নির্যাতন। তখন থেকেই ওই পুকুরটি খুনিয়াদীঘি নামে পরিচিত। এলাকার প্রবীণদের কাছে সেই নারকীয় কাহিনী শুনে আজও মানুষ ভয়ে শিউরে ওঠে।
পাকবাহিনী বালিয়াডাঙ্গী থানার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক আলহাজ্ব দবিরুল ইসলামের (বর্তমান এমপি) পিতা আকবর আলীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ তিরনই নদীতে ফেলে দেয়। ঝিকরগাছা গ্রামের ২৫ জন নিরীহ লোককে বাড়ি থেকে ডেকে এনে বালিয়াডাঙ্গী ক্যাম্পে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। হরিপুর থানার সাইফুদ্দীন, মহিরউদ্দীন, নুরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, মজিবর রহমান ও তার ভাই এবং হরিপুর মসজিদের ইমামসহ শতাধিক ব্যক্তিকে হরিপুর পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেনি। হরিপুরের ঝিগড়া গ্রাম, কুসলডাঙ্গীর বহু মানুষকে ধরে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। কামারপুকুর নামক এলাকায় প্রায় অর্ধশত হিন্দু-মুসলিমকে একসঙ্গে গণকবর দেয়া হয় বলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন।
মুক্তি: ২৯ নভেম্বর তত্কালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে গেলে তারা পিছু হটে ময়দানদীঘি, বোদা, ভূল¬ী হয়ে ঠাকুরগাঁও শহরে ঘাঁটি স্থাপন করে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণ চলতে থাকে সেখানে। পাকসেনারা ৩০ নভেম্বর ভূল¬ী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। তারা সালন্দর এলাকার বিভিন্ন স্থানে মাইন পেতে রাখে। মিত্রবাহিনী তাত্ক্ষণিকভাবে ভূল¬ী ব্রিজ মেরামত করে ট্যাঙ্ক পারাপারের ব্যবস্থা করে। ১ ডিসেম্বর ভূল¬ী ব্রিজ পার হলেও যত্রতত্র মাইনের কারণে মিত্রবাহিনীর ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকতে বিলম্ব হয়। ঐ সময় শত্রুদের মাইনে দুটি ট্যাংক ধ্বংস হয়। পরে কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ২ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর প্রচণ্ড গোলাগুলির মুখে পাকবাহিনী ঠাকুরগাঁও ছেড়ে পালায়। ৩ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে মিত্রবাহিনী।
বধ্যভূমি ও গণকবর সংরক্ষণ: মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাসে ঠাকুরগাঁওয়ের শতাধিক স্থানে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী ও তার দোসররা। এ পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে ৪টি বধ্যভূমি ও ৬টি গণকবর। বেশ কয়েকটিতে স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করা হয়েছে, তবে যথাযথভাবে সেগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। জাঠিভাঙ্গায় আংশিক নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের লোহার গেটটি ইতিমধ্যে চুরি হয়ে গেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী পীরগঞ্জের অধ্যাপক গোলাম মোস্তফার সমাধিস্থান সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ নেই। দখল হয়ে যাচ্ছে জমি। শহীদ অধ্যাপক মোস্তফার ছেলে আসাদুজ্জামান আসাদও জানালেন সেই কথা। তিনি বলেন, সরকার আজো তার বাবার সমাধিস্থলটি সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেয়ায় এক শ্রেণীর মানুষ সমাধির লাগোয়া জায়গা দখলের চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
গণহত্যাকারীদের বিচার দাবি: সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম জানান, এই এলাকায় যারা গণহত্যায় জড়িত ছিল তাদের অনেকে এখন সমাজে মাথা উঁচু করে চলছে, যথেষ্ট প্রভাবশালীও তারা। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। শহরের হাজীপাড়ার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও নাগরিক কমিটির সভাপতি ডা.শেখ ফরিদ বলেন, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তবে দ্রুত এই প্রক্রিয়া শেষ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাব সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা আখতার হোসেন রাজা জানান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এই বাংলার মাটিতেই হবে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস মুছে যাবে।