শুভ বড়দিন। প্রভু যিশুখ্রিস্টের পবিত্র জন্ম দিন। বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টেতে বিশ্বাসীরা যিশুর জন্ম দিন ২৫ ডিসেম্বর প্রতি বছর জাঁকজমকভাবে পালন করে থাকে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ০.৩% লোক খ্রিস্ট ধর্মালম্বী। বাংলাদেশেও বর্ণাঢ্য আয়োজনে খ্রিস্টানরা বড়দিন পালন করে থাকে। প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে প্রভু যিশুখ্রিস্টের এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ, মানুষের ইতিহাসে এটি একটি মহান দিন। যিশুর জন্ম দিন হচ্ছে আধুনিক শতাব্দীর জন্য ইতিহাসের নতুন সূচনা। যিশুর জন্মকে ঘিরে তৈরি হয়েছে যিশুর জন্মের পূর্ব এবং পরের ক্যালেন্ডার। এভাবেই যিশুর জন্ম মানুষের ইতিহাসকে এক নতুন প্রভাব তৈরি করে দিয়েছে। গালিলি শব্দের অর্থ বেষ্টিত স্থান। প্যালেস্টাইন দেশের একেবারে প্রত্যন্ত উত্তরের তিনটি প্রদেশ বেষ্টিত হয়ে (গালিলি, সমরীয়া ও যুদিয়া) অবস্থিত। সমগ্র গালিলি অঞ্চল অতি নয়ন-মনোহর, বর্ণাঢ্য ও সুফলাসমৃদ্ধ। এই গালিলির অন্যতম নগর নাজারেতে ঈশ্বর তার দূত গাব্রিয়েলকে যিশুর জন্ম বার্তা নিয়ে কুমারী কন্যা মেরির কাছে পাঠিয়েছিলেন; যা আমরা পবিত্র বাইবেল থেকে শিক্ষা পাই। ঈশ্বরের এই দূত মেরিকে বললেন, 'অয়ি পরমমহানুগৃহীতা, প্রভু তোমার সহবর্তী!' কিন্তু মেরি এ কথায় অতি উত্কণ্ঠিত হলেন, আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এ কেমন মঙ্গলবাদ? স্বর্গদূত তাকে বললেন, 'মেরি, ভয় কর না, কেননা তুমি স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে অনুগ্রহপ্রাপ্তা। আর দেখ, তুমি গর্ভবতী হয়ে একটি পুত্র-সন্তানের জন্ম দিবে, আর তুমি সেই পুত্র সন্তানের নাম রাখবে—যিশু। তিনি হবেন মহান, আর এই নামেতে হবেন তিনি অভিহিত—পরাত্পরের পুত্র। প্রভু ঈশ্বর তার পিতা দায়ুদের সিংহাসন তাহাকে দিবেন, তিনি যাকোবকুলের উপরে যুগে যুগে রাজত্ব করবেন ও তার রাজ্যের শেষ হবে না।' মেরি স্বর্গদূতকে বললেন, 'তা কেমন করে হতে পারে?' স্বর্গদূত তাকে বললেন, 'পবিত্র আত্মা তোমার উপরে আসবেন এবং পরাত্পরের শক্তি তোমার উপরে ছায়া করবে এবং পবিত্র সন্তান জন্মাবেন, তাকে ঈশ্বরের পুত্র বলা হবে।' এদিকে প্রভুর এক দূত স্বপ্নে যোশেফকে বললেন, 'যোশেফ দায়ুদ সন্তান, তোমার স্ত্রী মরিয়মকে গ্রহণ করতে ভয় কর না। কেননা তার গর্ভে যা জন্মেছে তা পবিত্র আত্মা হতে হয়েছে আর তিনি পুত্র প্রসব করবেন এবং তুমি তার নাম যিশু (ত্রাণকর্তা) রাখবে। কারণ তিনিই আপন প্রজাদেরকে তাদের পাপ হতে উদ্ধার করবেন।'
সেই সময় সমগ্র জাতির লোক গণনা শুরু হলো। এটা ছিল প্রথম লোক গণনা, যখন সিরিয়ার শাসনকর্তা কুরিনিয় ছিলেন। নাম লেখানোর জন্য সকলেই নিজ নিজ শহর-নগরে গেলেন। গালিলির নাজারত নগর হতে যোশেফও গেলেন যিহুদার ডেভিড নগরীতে, যে-নগরীকে বেথেলহাম নামেও অভিহিত করা হতো। তিনি নিজের বাগ্দত্তা স্ত্রী মেরির সাথে গেলেন নাম লেখার জন্য। তখন মেরি পবিত্র আত্মার দ্বারা গর্ভবতী ছিলেন। সেই স্থানে যখন তারা উপস্থিত হলেন তখন মেরির প্রসবকাল সম্পূর্ণ হলো; আর তিনি তার প্রথমজাত পুত্র প্রসব করলেন; আর তাকে কাপড়ে জড়িয়ে যাবপাত্রে শুয়িয়ে রাখলেন, কারণ পান্থশালায় তাদের জন্য স্থান ছিল না। সেই অঞ্চলে মেষপালকেরা চারণ ভূমিতে অবস্থান করছিল ও রাত্রিকালে নিজেদের মেষপাল পাহারা দিচ্ছিল। তখন প্রভুর দূত তাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন আর প্রভুর সুউজ্জ্বল মহিমায় চর্তুদিক আলোকময় হয়ে উঠল। এ ঘটনা দেখে তারা ভয় পেল। তখন স্বর্গদূত তাদের বললেন, 'ভয় কর না, কেননা আমি তোমাদের কাছে মহা আনন্দময় সুসমাচার বহন করে এনেছি; সে আনন্দের ভাগ সমুদয় লোকেরই হবে, কারণ আজ দায়ুদ নগরে তোমাদের জন্য ত্রাণকর্তা জন্মেছেন তিনি খ্রিস্ট প্রভু। তোমাদের জন্য এই চিহ্ন, তোমরা দেখতে পাবে, একটি শিশু কাপড়ে জড়ানো যাবপাত্রে শোয়ানো আছে।' তখন স্বর্গদূতেরা মিলিত কণ্ঠে ঈশ্বরের স্তবগীতি গাইতে লাগলেন, 'উর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে [তাঁর] প্রীতিপাত্র, মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি।' মেষপালকেরা বেথেলহামে গেলেন এবং সেই যাবপাত্রে শিশু যিশুকে দেখতে পেলেন। বেথেলহামে যিশুর জন্মের পর পূর্বদেশীয় পণ্ডিতরা যিরুশালেমে এলেন এবং আকাশের একটি তারার সহায়তায় (যে তারাটি যিশুর জন্মের ঘরের উপরে স্থির হয়েছিল স্থান নির্দেশক হিসেবে) যিশু জন্মের ঘরটি খুঁজে পেলেন। পণ্ডিতরা উক্ত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ভূমিষ্ট হয়ে যিশুকে প্রণাম করলেন। তারপর পণ্ডিতরা তাঁকে (যিশুকে) উপহার স্বরূপ স্বর্ণ, কুন্দুরু ও গন্ধরস দিলেন। খ্রিস্ট অর্থ-আদর্শ এবং নিখুঁত-নিষ্কলঙ্ক মনুষ্যত্ব সম্পন্ন 'মানব'-ই হলেন খ্রিস্ট। এই মহামানব জগতে প্রবেশ করেছিলেন পবিত্র আত্মার ছায়ায়; কোনো জাগতিক সঙ্গম-সম্ভোগের মাধ্যমে নয়। প্রেম বা ভালোবাসা হলো খ্রিস্ট ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহত্ গুণ। এই অন্ধকারাছন্ন পাপময় পৃথিবীতে প্রভু যিশুখ্রিস্ট উজ্জ্বল জ্যোতিস্বরূপ, উদ্ধারকর্তা হিসেবে এই জগতে এসেছেন। খ্রিস্টের জন্মের মূল অর্থ হচ্ছে, যারা অসহায়, বিচলিত, যারা বেদনার্ত, তাদের প্রতি প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা প্রকাশের। আর যারা পরিশ্রান্ত ও অন্ধকারে আছে তাদেরকে আলোর পথে আনার উদ্দেশ্যেই খ্রিস্টের আর্বিভাব। বড়দিন কেবল বাহ্যিক আনন্দের বিষয় নয়; এদিন আত্মিকভাবেও মিলনের দিন। ক্ষমা হচ্ছে মিলনের পূর্ব শর্ত। কেননা ক্ষমায় আনে মিলন, মিলন আনে অন্তরে শান্তি ও সম্প্রীতি, শান্তি মনে আনন্দ জাগায়, উত্সবে আনন্দের প্রকাশ ঘটে, উত্সব নিয়ে আসে সম্প্রীতির বন্ধন এবং বন্ধন আনে জীবনের অগ্রগতি। খ্রিস্টানদের কাছে বড়দিন উত্সব অত্যন্ত তাত্পর্য ও গুরুত্ব বহন করে। এজন্য তারা নাড়ির টানে তাদের প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হয় উত্সব পালন করার জন্য। নিজ নিজ বাড়িতে তারা ছুটে যান। পরস্পরের মধ্যে কার্ড, এসএমএস ও উপহার বিনিময় হয়। বড়দিন শিশু-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ধনী-গরিব সমগ্র মানব জাতির হূদয়ে স্বর্গীয় প্রশান্তির প্রতিফলন ঘটে। যা নাচে গানে কিংবা অতিথি আপ্যায়নে বড়দিনের প্রতিটি মুহূর্ত মহামিলনের শ্রোতধারায় উত্সব মুখর হয়ে উঠে। বড়দিন হলো হূদয়-মনের উদারতা, ভালোবাসা ও ক্ষমার আদর্শে ঈশ্বর ও মানুষের মিলনানুষ্ঠান। এই বড়দিনকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টান গৃহিণীরা ঘরদোর পরিষ্কার পরিছন্ন করে। খ্রিস্টানরা সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন কাপড়-চোপড়ে নিজেদের সাজাতে চেষ্টা করে। নানা রকম সাজসজ্জায় তাদের গৃহ সজ্জিত হয় এবং সর্বান্তকরণে খ্রিস্টানরা যিশুকে নতুন করে বরণ করে। তাই যিশু নতুন করে আবারও জন্ম নেয় খ্রিস্টানদের হূদয়ে। তাদের উপসনালয় স্থানগুলো নানাভাবে সজ্জিত করে। বড়দিনের দিন বিশেষ উপাসনা সভা হয়ে থাকে। উপাসনার পর অনেক গ্রামগুলোতে সম্মিলিত বড়দিন ভোজ আয়োজন করা হয়ে থাকে। খ্রিস্টান গ্রামগুলোতে বড়দিনের কীর্তন গান, পিঠে পায়েস, বড় দিনের নাটক ইত্যাদি আয়োজন করে থাকে। যুবক-যুবতীরা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি এবং এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে গাদোয় (নাচ-গান) করে থাকে। এই বড়দিনে, শান্তির রাজপুত্রের জন্মদিনে, অশান্তির কালো ছায়া, ভয়, হিংসা, ভেদাভেদ ভুলে সবাই মিলে যথাযথ মর্যাদায় প্রভু যিশুর এই জন্মোত্সব পালন করে থাকে।