
গণতান্ত্রিক সরকারকে বাঁচিয়ে রাখার কিংবা বিদায় জানানোর ক্ষমতার মালিক হচ্ছে জনগণ। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে জনগণ একটি দলকে সরকারে বসিয়ে দেশ শাসন করার সুযোগ দেয়। মেয়াদ শেষ হবার আগে সরকারের পদত্যাগ দাবি করতে গেলে তার পেছনে বড় যুক্তি থাকা উচিত। থাইল্যান্ডে তেমন জোরালো যুক্তি না থাকা সত্ত্বেও ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার মাত্র ২ বছরের মাথায় পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিলেন থাই প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা। এরপর তিনি নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে জনগণের ভোটের উপর নিজের ভাগ্য সঁপে দিলেন। জনগণ যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে তবে বিরোধী দলের আসনে বসবেন বলে ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা আরেকটু বেশি চায়। তবে সেই চাওয়া গণতন্ত্র কিংবা সংবিধান মেনে নয়। তারা প্রধানমন্ত্রী ইংলাকের পদত্যাগ চায়। ইংলাক বিক্ষোভ দমনের পথে যাননি, তাতে তারা খুশি। গত নভেম্বরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরুর পর ইংলাক প্রথমে অনমনীয় আচরণ করলেও পরে নমনীয় হন। বিক্ষোভকারীরা তাতেও খুশি। পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়েছেন তাতেও বেজায় খুশি। কিন্তু তিনি যে আবার ভোটারদের হাতে নিজের ভাগ্য সঁপে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন তাতে তারা বেজায় অখুশি। অখুশি এই কারণে যে তারা মনে করছে ভোট হলে জনগণ আবারো ইংলাকের দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতে পারে। তাদের দাবি, নির্বাচন না দিয়েই ইংলাক এবং তার দলকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে! তার পরিবর্তে গঠন করতে হবে একটি অনির্বাচিত সরকার, বিক্ষোভকারীরা যার নাম দিয়েছে 'পিপলস কাউন্সিল'। অর্থাত্ বিচার মানলেও 'তালগাছটা' তাদের দিতেই হবে।
অগণতান্ত্রিক তালগাছটা চেয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। যেকোনো মূল্যে নির্বাচন প্রতিহত করার ডাকও দিয়েছে। তারা নিজেরা তো নির্বাচনে অংশ নিবেই না, যারা অংশ নিতে চায় তাদের সেই সুযোগ দিবেও না। সরকারি দল ছাড়াও আরো ৩০টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্র্যাট পার্টি সেই নির্বাচনে কাউকে অংশ নিতে দেবে না। শক্তি প্রয়োগ করে তারা কেবল ইংলাকের দলকে ক্ষমতায় যাবার হাত থেকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়। বিরোধীদের এমন মনোভাবের তুমুল সমালোচনা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। কিন্তু তাতে পরোয়া করছে না তারা। গণতান্ত্রিক বিক্ষোভের মাধ্যমে ইংলাকের সরকারের পতন ঘটাতে পারলেও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তারা যাবে না। বিক্ষোভকারীদের নেতা সুথেপ থগসুবান বলেছেন, কিছু রাজনৈতিক সংস্কার না করে নির্বাচন দিলে আবারো ইংলাকের দল ফিউ থাই পার্টি ক্ষমতায় আসতে পারে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই তথাকথিত রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা আগেই ফাঁস হয়ে গেছে। সংস্কারের নামে মূলত ইংলাকের দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। বিক্ষোভকারীরা রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে এমন নিশ্চয়তা চায় যে ইংলাক কিংবা তার পরিবারের কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। অর্থাত্ বিরোধী দল ডেমোক্র্যাট পার্টির বিজয়ের নিশ্চয়তা না পেলে তারা নির্বাচন হতে দিবে না। এমন পরিস্থিতিতে সামনে এসেছে সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান প্রায়ুথ বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে উভয়পক্ষকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সহিংসতা যেন না হয়। এমনকি সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাও তিনি নাকচ করে দেননি। তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনী কোনো পক্ষের হয়ে কাজ করবে না। তবে পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নেবে সেনাবাহিনী। ধারণা করা হচ্ছে, ক্ষমতা দখল করার জন্য তৈরি হয়েই আছে সেনাবাহিনী। এর আগে থাইল্যান্ডে ১১ বার সফল সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এদিকে, কেবল নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বিক্ষোভকারীরা। তারা প্রার্থী রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রও দখল করে সেখানে অবস্থান নিয়েছে। ফলে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অগণিত প্রার্থী মনোনয়নপত্র কিনতে এবং জমা দিতে পারেননি।
নির্বাচন ভন্ডুল করতে বিক্ষোভকারীরা গত সোমবার থেকে তাদের আন্দোলন আরো জোরদার করেছে। থাইল্যান্ডে প্রায় একবছর ধরে চলা রাজনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে সর্বশেষ অধ্যায়। উল্লেখ্য, থাইল্যান্ডের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ গরীব লোক ইংলাক ও থাকসিন সিনাওয়াত্রার সমর্থক। অন্যদিকে শহরভিত্তিক ধনী ও ভিআইপিরা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা ২০০৬ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। পরে তাকে নির্বাসিত করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান পারাদোর্ন পাত্তানাতাবুত জানান, রবিবার রাজধানীতে সরকার বিরোধী সর্বশেষ গণআন্দোলনে কমপক্ষে দেড় লাখ লোক অংশ নেয়। সোমবার শত শত বিক্ষোভকারী ব্যাংককের একটি স্টেডিয়ামের চারদিকে অবস্থান নেয়। সেখানে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নাম রেজিস্ট্রেশনের কাজ চলছিল। কিন্তু সেটি দখল করে কর্মকর্তাদের বিতাড়িত করে বিক্ষোভকারীরা। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা সমচাল শ্রীসুথিইয়াকর্ন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, থাইল্যান্ডের নয়টি দল ওই স্টেডিয়ামের মধ্যে প্রবেশ করতে সমর্থ হলেও কর্মকর্তারা তাদের নিবন্ধনের কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি। তিনি জানান, প্রায় ২৪টি দল পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে যে, তাদের স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে।
এদিকে, বিরোধী দল সংস্কার সংস্কার করে গলা ফাটানোর কারণে ইংলাক গত শনিবার দেশে সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তো ইংলাককেই সংস্কারের প্রধান টার্গেট বানাতে চায়। তাই তার নেতৃত্বে সংস্কার প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করে। বিক্ষোভকারীদের দাবি, আগামী নির্বাচনের আগে গণতন্ত্র স্থগিত রেখে অনির্বাচিত 'পিপলস কাউন্সিল' গঠন করতে হবে। এই পিপলস কাউন্সিলই প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে ইংলাক বলেন, 'সরকার দেশে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে একমত এবং এলক্ষ্যে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। আমার আবারো আশ্বস্ত করতে চাই, নির্বাচনের পাশাপাশি সংস্কার প্রক্রিয়া চলবে।' বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন ডেমোক্র্যাটিক দলের জন্য উভয় সংকট ডেকে এনেছে। কারণ দলটি যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নিলে বিক্ষোভকারীরা নাখোশ হতে পারেন। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে থাইল্যান্ডের সবচেয়ে পুরানো দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।